গত কয়েক মাসে দেশের সাত বিভাগের পঁচিশটা জেলায় ঘুরে বেড়াতে হয়েছে শিশুকিশোরদের অধিকার-বিচার নিয়ে কিছু ফিল্ডওয়ার্কের কাজে। প্রায় শতাধিক গ্রামে হাজারখানেক মানুষের সাথে কথা বলবার পর এই দেশ, দেশের মানুষ এবং আমাদের সামাজিক সমস্যা-সম্ভাবনা সম্পর্কে আমার জানাশোনা এবং চিন্তা-চেতনায় কিছু আমূল পরিবর্তন এসেছে, সময়ে-অসময়ে সেগুলো হয়তো বলার চেষ্টা করবো।

ঢাকা থেকে জেলা শহরের গ্রামে নিজের ফুফু বাড়িতে আসার পর ফুফার হাতেই ধর্ষিত হয়েছিল তেরো বছরের একটা মেয়ে। কোন এক আবাসিক প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা আর সবার মতই তাকেও প্রশ্ন করা হল, তোমার ভবিষ্যতে কি হবার ইচ্ছা, তুমি কি চাও ? উত্তর ছিল সহজ – আমি শুধু বাসায় ফিরতে চাই। গর্ভবতী মেয়েটার চোখের শূন্যতা আমাদেরকে আর কোন কথা বাড়াতে সুযোগ দেয়নি।

আদালত তাকে বাবা-মায়ের জিম্মায় দিয়ে দিতে ইচ্ছুক, শর্ত একটাই – বাবা অথবা মা অথবা কোন অভিভাবককে নিজে এসে তাকে নিয়ে যেতে হবে। মেয়ের বাবা-মা অতি দরিদ্র, দিনমজুর মানুষ। ঢাকায় তারা কোথায় থাকেন তার ঠিক-ঠিকানা নাই, মেয়ে এইখানে একটা নিরাপদ আশ্রয়ে আছে, বরং ভালোই আছে, খেতে-পরতে পাচ্ছে। সেই বাবা-মায়ের সামর্থ্য নেই পয়সা খরচ করে ঢাকা থেকে এসে এই গর্ভবতী মেয়েটাকে ঘরে ফিরিয়ে নেবার।

আমাদের ‘সিস্টেম’ এইখানে তাকে সাহায্য করতে পারবে ? লিগ্যাল এইড মানবাধিকার নারী নির্যাতন হ্যান ত্যান ? এইখানে কবি নীরব।

কিংবা, আরেক জেলাতে ১৬ বছরের এক নওজোয়ানের সন্ধান পাওয়া গেল যে তার পুরুষত্বের প্রমাণ দিয়েছে প্রতিবেশী ১০ বছরের এক বাচ্চা মেয়ের ওপর। মেয়ের পরিবার অতিদরিদ্র, সুতরাং চেপে যাওয়া, ভয়ভীতি এবং সমঝোতার সেই পুরনো গল্পেই সব শেষ হতে যাচ্ছিলো, যদি না গ্রাম্য হাতুড়ে ডাক্তার সেলাই করতে গিয়ে ভেজাল না বাঁধাত। কয়েক সপ্তাহ পর ব্লিডিং ইনফেকশন নিয়ে মেয়েটা জেলার হাসপাতালে গেলে তাকে সেখান থেকে ‘সুচিকিৎসা’র জন্য বড় শহরে রেফার করে দেয়া হল। অতিদরিদ্র সেই বাবা-মায়ের জন্য শহুরে আধুনিক হাসপাতালে যাওয়ার চেয়ে গ্রামের কবরস্থানে যাওয়াটাই সম্ভবত সহজ ছিল। যা হোক, কিছু সচেতন মানুষের অক্লান্ত চেষ্টায় (পুলিশ, সমাজকর্মী এবং সরকারী কর্মকর্তা) তাকে জেলার হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো। আমরা ২৪ ঘন্টা পরেও শুনেছিলাম সেই হাসপাতালে তার ‘চিকিৎসা’ তখনও শুরু হয় নি।

আমাদের ‘সিস্টেম’ এইখানে তাকে সাহায্য করতে পারবে ? এইখানে কবি নীরব।

বিগত ৩ বছরে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও নারীদের ওপর অন্যান্য অপরাধ
২০১৩ সালে ১৮০৯৬ টি
২০১৪ সালে ১৯৬১৩ টি
২০১৫ সালে ১৯৪৯৮ টি
(সূত্রঃ মানবজমিন ২৩ শে মার্চ, ২০১৬)

কতটি ইভেন্ট/ স্ট্যাটাস/ কনসার্ট করা হয়েছে এগুলোর প্রতিবাদে ?

 

বিপরীতমুখী ঘটনাও আছে। বন্ধুবান্ধবের ষড়যন্ত্রে পড়ে ইভ-টিজিং চাঁদাবাজির মামলায় ফেসে যাওয়া এক নিরীহ এসএসসি পরীক্ষার্থীর গল্প, এলাকায় পরাক্রমশালী নারী বাদীনী ‘নির্যাতিতা কন্যার মাতা’র ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করে তাকে হাজতে ঢুকিয়েছেন, দয়াপরবশ হয়ে অবশ্য এখন আপসের প্রস্তাবও দিচ্ছেন, ‘সামান্য’ কটা টাকা হলেই হবে। বাবা-হারা ছেলের মা স্বল্প বেতনে চাকরী করেন, চোখের পানি ছাড়া তার আর কোন সম্বল নেই। এই ছেলের ভবিষ্যৎ কি ? নম্র-ভদ্র ছেলেটাকে প্রতিশোধপরায়ণ সন্ত্রাসী হয়ে ওঠা থেকে বাঁচাতে আমাদের ‘সিস্টেম’ তাকে সাহায্য করতে পারবে কি ?

এইখানেও কবি নীরব।

এইরকম শত শত মানুষের মত আরও একজন বোন নির্যাতিত হয়েছেন, মারা গিয়েছেন; স্রেফ তার কিছু ভালো ছবি ফেসবুকে পাওয়া যাচ্ছে, নেক্রোফিলিয়াক কেউ কেউ বিকৃত ছবিটবি দিয়েও মজা নিতে পারছেন, কিংবা সমাজে তার একটা অবস্থান ছিল বিধায় আমরা আজকে সোচ্চার হয়েছি, একই দিনে এক সেলিব্রেটি সঙ্গীতশিল্পীর বাসায় তার ‘কাজের মেয়ে’ একইভাবে নির্যাতিত নিহত হয়েছেন, আমরা জানিও না। কাজের মেয়ের মৃত্যুর প্রতিবাদটা ঠিক ততটা গ্ল্যামারাস না, এদের ফেসবুক নেই, বন্ধুবান্ধব ভদ্রসমাজও নেই।

সিলেক্টিভ মানবিকতার বহিঃপ্রকাশ অবশ্য আমাদের অনেকদিনের, পাল্টানো অত সহজ না।

এই বর্ণবাদী মানবিকতা আর আহা-উহু সহানুভূতির ঠুলি না লাগিয়ে, হুটহাট আবেগিক রেসপন্স কমিয়ে নিজের অবস্থান থেকে সিস্টেম বা ব্যবস্থাটাকে নিয়ে কাজ করা শুরু করলেই পরিবর্তন আসবে। অফলাইনে দশ মিনিটের দুটো কথা, একটু মোটিভেশন কিংবা ছোট একটা কাজও অনলাইনের শত ইভেন্ট প্রতিবাদ স্ট্যাটাসেরর চেয়ে বেহতর, এইটা যদি আমরা না বুঝি, তাহলে অন্তত চুপ থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

অবশ্য ঠিক ততদিনের জন্য, যতদিন আমি বা আমরা নিজেরাই কেউ ভিকটিম হয়ে এইরকম গল্পের অংশ হয়ে যাই………