এই লিখাটি সর্বপ্রথম প্রকাশ হয়েছিল পাঠচক্র অনলাইন ম্যাগাজিনে

মেপ

শরীয়াহ বললেই এখন আমাদের চোখে ভেসে ওঠে দায়েশ কিংবা বোকো হারামের হাই ডেফিনিশনে ঝকঝকে গলাকাটা বা পোড়ানোর ভিডিও, আরব দেশে একসাথে সহস্রজনের শিরোচ্ছেদ, বেত্রাঘাত বীভৎসতা আর নারী নির্যাতন। বিষয়টা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছে যে, ইদানিং অনেক মুসলমান বুদ্ধিজীবিই তাদের লিখায় আর এই ‘শরীয়াহ’ শব্দটা ব্যবহার করতে চান না, কারণ এটি মানুষকে ভয় পাইয়ে দিবে  কিংবা স্রেফ এই এক শব্দের ব্যবহারেই তাদের সকল লেখালেখি সম্বন্ধে জঙ্গীবাদী সন্দেহ করা শুরু হয়ে যাবে। অবশ্য এই আশংকা নেহায়েত অমূলকও নয়।

শরীয়াহ নিয়ে কথা উঠলেই চলে আসে শরীয়াহভিত্তিক আদালতের কথা। মুসলিম দেশগুলোর পাশাপাশি ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক জায়গাতেই শরীয়াহভিত্তিক আইন ও বিচার (শুধুমাত্র মুসলিম পারিবারিক ও সম্পত্তি নিয়ে) চালু আছে, অনেক জায়গায় অবশ্য আইন করে শরীয়াহ’র প্রয়োগ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। যেমন, ব্রিটেনে ১৯৯৫ সালের আরবিট্রেশন আইনের আওতায় মুসলিম কম্যুনিটির সদস্যদের ঐচ্ছিক সুযোগ হিসেবে মূলত পারিবারিক বিষয়াদির সমঝোতামূলক মীমাংসাকারী হিসেবে শরীয়াহ আদালতগুলো কাজ শুরু করে। দু’টি ধারায় – মুসলিম আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনাল এবং ইসলামিক শরীয়াহ কাউন্সিল নামের দু’টি ইন্সটিট্যুশন ব্যক্তিক পর্যায়ে শরীয়াহর প্রয়োগ শুরু করে, এবং তখন থেকেই নানা ধরণের আগ্রাসনের শিকার হয়। এই ‘আগ্রাসী’ শরীয়াহ আদালতকে প্রচলিত ‘মহান বিচার ব্যবস্থা’র সমান্তরাল রবং অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আক্রমণ এবং অপপ্রচার চালানো হয়।

যেমন, খুব সম্প্রতি ম্যাশেলড জি নামের একজন ডাচ গবেষক লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পিএইচডি থিসিস হিসেবে ‘Choosing Sharia?: Multiculturalism, Islamic Fundamentalism & Sharia Councils’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছেন ২০১৬ এর জানুয়ারী মাসে, যেখানে ব্রিটেনের শরীয়াহ কোর্টগুলোর ‘গোপন প্রকোষ্ঠের অন্ধকারাচ্ছন্ন গল্প’গুলো (?!) তিনি প্রকাশ করবার চেষ্টা করেছেন। এই গবেষণার অংশ হিসেবে তিনি ২০১৩ সালে ব্রিটেনের বেশ কিছু শরীয়াহ আদালত পর্যবেক্ষণ করেন, এবং তার ভাষায় এগুলো মুসলিম নারীদের জন্য খুবই অসম্মানজনক এবং অনেক ক্ষেত্রেই তাদের অধিকারের জন্য বুমেরাং হিসেবে কাজ করে। স্বাভাবিকভাবেই তার এই গবেষণা ব্রিটিশ মিডিয়া সহ ইউরোপের মিডিয়াগুলোতে ভালো কাভারেজ পেয়েছে।

অ্যাওয়ার্ড উইনিং চলচ্চিত্র নির্মাতা রুহী হামিদ ২০০৭ সালে বিবিসি’র জন্য এক ঘন্টার একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেছিলেন, যার নাম ‘ইনসাইড এ শরীয়াহ কোর্ট’। এখানে ব্রিটেনে প্রচলিত শরীয়াহ আদালতগুলোর ওপর পাবলিক পারসেপশন বা জনমানুষের ধারণা কেমন সেই বিষয়টি উঠে আসে, এবং যথারীতি সেটা ছিল নেগেটিভ – বর্বর, নারী নির্যাতন, বীভৎসতা এবং পশ্চাৎপদ। এরপর তিনি চলে যান নাইজেরিয়াতে, যেখানে ব্রিটেনের উত্তরাধিকার ‘সাধারণ আইন’ বা কমন ল এর সাথে একই ধারায় চলমান শরীয়াহ আদালতগুলোর কার্যক্রম কিভাবে চলছে, তা উঠে আসে তার ক্যামেরায়।

জামফারা

নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলের জামফারা প্রদেশটি মূলত মুসলিম অধ্যুষিত, তবে সেখানে খ্রিষ্টান জনবসতিও আছে। ২০০০ সালে স্থানীয় নির্বাচনে ম্যান্ডেট হিসেবে শরীয়াহ আদালত প্রচলন করা হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় মুসলিম-খ্রিষ্টান দাঙ্গা পর্যন্ত বেঁধে যায়, তবে ধীরে ধীরে এই ক্ষত শুকিয়ে আসে। কলোনিয়াল উত্তরাধিকার হিসেবে নাইজেরিয়ার আইন ব্যবস্থা ব্রিটিশ কমন ল’কেই অনুসরণ করে। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে জামফারা প্রদেশে শরীয়াহ আদালতের সংযোজন সেখানকার মানুষদের মধ্যে এক অদ্ভুত জাগরণ নিয়ে আসে। ডকুমেন্টারীতে উঠে এসেছে কিভাবে খুব সহজে গ্রামীণ দরিদ্র মানুষ বিচার পাচ্ছে, বিচারক তথা ‘কাজী’ মহোদয় (যদিও খুব কনভিন্সিং মনে হয় নি তাকে, দুর্গম এক গ্রাম্য বিচারকের কাছে এর চেয়ে বেশি জ্ঞান আশা করাও কঠিন) তার কম্যুনিটির লোকজনের বিচার করছিলেন, ছোট চুরির ‘অভিযোগ’ এর বিপরীতে কারাবাস অথবা শরীয়াহ আদালতের হুকুমে বিশটি বেত্রাঘাত – আসামী নিজেই বেত্রাঘাতের আদেশ বেছে নিল, আদালত প্রাঙ্গনে প্রকাশ্যে খুব সহজে তা কার্যকর করা হলো, এবং এরপর আসামী চলে গেল। পারিবারিক বিবাদ মীমাংসায় কুরআনের বিধাণের আলোকে স্বল্প সময়ে সমাধান হয়ে গেল, বাদী-বিবাদী উভয়েই তা মেনে নিয়ে চলে গেলেন। এভাবে কোন ধরনের আইনজীবি, বাগবিতন্ডা ছাড়া স্বল্প-সময়ে গ্রামবাসীরা বিচার পাচ্ছিল যা দুই পক্ষেরই মনোঃপুত হয়েছে।

তবে একমত না হলে জেলা পর্যায়ের আদালতে ‘সাধারণ আইনে’ আপীলের সুযোগ থাকছে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা, ২০০০ সাল থেকে ২০০৭ সালে ডকুফিল্মটি তৈরির সময় পর্যন্ত মাত্র দু’টো বা তিনটি মেজর শাস্তির (হাত কাটা বা মৃত্যুদন্ড) আদেশ এসেছে শরীয়াহ আদালত থেকে, তবে কোন মৃত্যুদণ্ডই তখন পর্যন্ত কার্যকর করা হয়নি। মোটকথা, খোলা মন নিয়ে এই ডকুফিল্মটি দেখলে তা চোখ খুলে দেবার জন্য যথেষ্ট।

নাইজেরিয়ার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে শহরাঞ্চল, কিংবা আরব বিশ্ব বা মধ্য প্রাচ্য কিংবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে নিরপেক্ষ ডাটা তুলে আনলে শরীয়াহ আদালতের বিচার প্রক্রিয়ার কম-বেশি এই ধরনের চিত্রই উঠে আসবে। তবে মামলা তদন্ত-প্রমাণের ক্ষেত্রে কিছু কিছু বিষয় সংযোজন করবার জন্য আলিম এবং মুফতীরা চিন্তা-ভাবনা করতে পারেন/ করছেন, যেমন ফরেনসিক এভিডেন্স। এ ক্ষেত্রে উল্ল্যেখ করা যেতে পারে, অনেক ‘কমন-ল’ দেশও কিন্তু ফরেনসিক এভিডেন্স কিংবা অন্যান্য প্রযুক্তিগত সাক্ষ্যপ্রমাণ বিচারপ্রক্রিয়ায় গ্রহণের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে, আমাদের বাংলাদেশও তার মধ্যে অন্যতম।

উসমানী২

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, পৃথিবীর যে কোন দেশেই আইনব্যবস্থার অন্যতম প্রধাণ বৈশিষ্ট্য হলো এর জটিলতা। আইনী কাঠামো, বিশেষ ভাষা, আদালতের প্রক্রিয়া এবং আরও নানাধরণের আবরণী পেরিয়ে সত্যিকার ন্যায়বিচার পেতে আমাদের অনেক সময় লেগে যায়, এবং এই প্রক্রিয়ার ঢিলেঢালা সুতোর ফাঁক গলে অনেক অপরাধীই সহজে বেরিয়ে যায়। বিশেষ করে ব্রিটেন-শাসিত ঔপনিবেশিক ‘কমন-ল’ দেশগুলোতে প্রচলিত অ্যাডভারর্সারিয়াল ব্যবস্থায় বিচারকের ভূমিকা থাকে খুবই সামান্য। তদন্ত এবং অপরাধ দমনে প্রধাণতম অংশে থাকেন পুলিশ এবং আইনজীবিরা, দরিদ্র-অসহায় মানুষের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই ন্যায়বিচার পাবার ক্ষেত্রে বরং বুমেরাং হিসেবে কাজ করে। ‘ইনসাইড এ শরীয়াহ কোর্ট’ ডকুমেন্টারীটিতে বিচারপ্রার্থী এক অতিদরিদ্র খ্রিষ্টান বাবার করুণ আর্তি তুলে আনা হয়েছে, যার নাবালিকা কন্যাকে জোর করে মুসলমান বানিয়ে বিয়ে দেয়া হয়েছে অন্যস্থানে। সুসজ্জিত ও বিজ্ঞ আইনজীবিগণ আদালতের সামনে তুখোড় ভাষায় যখন এই মামলার অ্যাডমিসিবিলিটি এবং জুরিসডিকশন (আদালতের বিচারক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন) নিয়ে শাণিত যুক্তি দিয়ে যাচ্ছেন, দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে সেই বাবা বলছিলেন, ‘এই মামলা কে বিচার করতে পারে আর পারে  না তাই নিয়ে শুনানী হচ্ছে দিনের পর দিন, অথচ আমার মেয়ের কথা কেউ ভাবছে না।’

কোর্টশরীয়াহ কোর্ট কায়েম হওয়ার পর নাইজেরিয়ায় সবচাইতে অখুশি হয়েছে সেখানকার আইনিজীবিরা। কারন মামলা গেছে কমে, আর মামলার মীমাংসাও হয় খুব দ্রুত। শরীয়াহ কোর্টে যে কেউ এসে সরাসরি কাযী বা জাজ এর সাথে মামলা পরিচালনা করতে পারে, উকিলের প্রয়োজনীয়তা নাই। ফলে উকিল সাহেবদের পকেটে পড়ছে টান। এই ব্যাপারটা উঠে এসেছে ডকুমেন্টারিতে। মূলত মাকাসিদ আল শরীয়াহ বা শরীয়াহ’র উদ্দেশ্য ছিল এইটাই। শরীয়াহ কায়েম হলে মামলা মোকাদ্দমার প্রয়োজন কমে যাবে।

আইন এবং বিচার ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য কি ? অপরাধের প্রতিরোধ, নাকি অপরাধীর প্রতিশোধ ? এই উত্তরাধুনিক সময়ে শরীয়াহ এবং শরীয়াহ আদালতকে আক্রমণের অন্যতম প্রধাণ অস্ত্র হচ্ছে, এই ব্যবস্থার ‘চোখের বদলে চোখ প্রাণের বদলে প্রাণ’ ঘরানার শাস্তিগুলো হচ্ছে মূলত বর্বরতম প্রতিশোধ, অথচ শরীয়াহর লক্ষ্য সম্পূর্ণ এর বিপরীত – সমাজের চোখে দৃষ্টান্ত স্থাপন করাই হচ্ছে এর মূল কাজ, যেন অপরাধী এই ধরনের কাজে আগ্রহী না হয়। ব্যভিচার প্রমাণে চারজন সাক্ষীর উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে হযরত সাদ বিন উবাদা (রাঃ) এর সাথে রাসূল (সাঃ) এর আলোচনাতেই বিষয়টা পরিস্কার হয়ে ওঠে, যেখানে চরমতম শাস্তির আগে কত কঠিনভাবে প্রমাণের বিষয়টি তুলে আনা হয়েছে, যেন সমাজের ভারসাম্য বজায় থাকে। একইভাবে, চরমতম অপরাধগুলোর ক্ষেত্রেও বিচারের আগে শান্তিপূর্ণ মীমাংসা, দিয়াত বা রক্তপণ এবং স্রেফ নিঃশর্ত ক্ষমালাভের মত বিষয়গুলো এক শরীয়াহ ছাড়া আর কোথাও দেখা যায় না। হযরত মায়েজ (রাঃ) যখন নিজেই ব্যাভিচার স্বীকার করে নিজের মৃত্যুদণ্ড চেয়ে নিচ্ছিলেন, অনেক সাহাবা তার সপক্ষে সুপারিশ করতে আসলে রাসূল (সাঃ) বলেছিলেন, ‘তোমরা আমার কাছে নিয়ে আসার আগে কেন তাকে বোঝালে না।’ অর্থাৎ আদালতের বাহিরে ন্যায়সঙ্গত ভাবে উভয়পক্ষের সমঝোতায় কল্যাণমুখী সমাধান পাবার প্রবিধাণটি শুধু শরীয়াহ’তেই সম্ভব। আমাদের ‘আধুনিক’ এবং ‘মানবিক’ আইনে অনিচ্ছাকৃত অপরাধ কিংবা অপরাধের চেষ্টাও সমান দোষের মধ্যে পড়ে, সমান শাস্তি ভোগ করে।

যে কোন অপরাধের শাস্তির ক্ষেত্রে এই ‘ডিটারেন্স’ বা ভয় দেখানোর ক্ষমতা আসলে কতটুকু কার্যকর এই বিষয়ে জুরিসপ্রুডেন্স এবং ক্রিমিনোলজীতে অনেক তর্ক-বিতর্ক আছে, অপরাধবিজ্ঞানী এবং আইনিজীবি-বিচারকেরা এই নিয়ে কখনোই একমত হতে পারেন নি। তবে মানুষের সমাজে অপরাধ এবং অপরাধীকে দমন করবার উপায় একটিই, তার বাদী-বিবাদী-বিচারক প্রত্যেকের নিজের বিবেক অর্থাৎ আত্নাকে শক্তিশালী করা, প্রয়োজনে শাস্তি দেয়া এবং সংশোধন করা। শরীয়াহ আদালত এবং বিচার ব্যবস্থা মানুষের ‘অপরাধপ্রবণতার’ স্বাভাবিকতা বা ফিতরাতকে স্বীকৃতি দিয়ে তার আধ্যাত্নিক চিকিৎসার চেষ্টা চালায়। ইসলামের হুদুদ বা ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট আমাদের ওরিয়েন্টালিস্ট, মডার্নাইজড, আরবান মিডল ক্লাস মননে বীভৎস হিসেবে মনে হলেও এর নীচে প্রবাহমান দর্শন এবং বৃহত্তর সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আনলে সেটা বীভৎস নয়, বরং মানবতার জন্য অতীব প্রয়োজনীয় তাতে কোনো সন্দেহ নাই।