সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে চলমান আইনী-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিতর্কটি চলছে, তার একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া সংক্রান্ত আলোচনা। অনলাইনে বিশেষত ব্লগে ইসলাম সহ ইন্যান্য নান ধর্মকে কটাক্ষ করে পোস্ট দেয়া এবং তা থেকে ছড়িয়ে পড়া বিতর্কে একপক্ষ বলছেন ধর্মীয় অনুভূতির কথা, আরেকপক্ষ বলছেন মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা। মূলত সারা বিশ্বজুড়েই এই বিতর্ক এখন তুঙ্গে। ক’দিন আগেও রাসূল (সাঃ) এর জীবনচিত্র ব্যঙ্গ করে ফুটিয়ে তোলা শর্টফিল্ম “ইনোসেন্স অফ মুসলিম” নিয়ে সমগ্র পৃথিবীতে প্রতিবাদ -সমালোচনার ঝড় বয়ে গিয়েছিলো। ক্ষেত্রবিশেষে তা সহিংস রূপও ধারণ করে, যেমনটি ঘটেছে আজকের বাংলাদেশে। একজন ব্লগার হত্যাকান্ডের পর তার এবং একই চিন্তাধারার আরও কিছু ব্লগারের ইসলামবিদ্বেষী কিছু পোষ্ট নজরে আসে দেশবাসীর এবং সঙ্গত কারণেই এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষ ও আলেম সমাজ। তার মাত্র অল্প ক’দিন আগেও ফেসবুক স্ট্যাটাসে মহানবী (সাঃ) এর অবমাননার জের ধরে কক্সবাজারের রামু, উখিয়া সহ আরও কিছু স্থানের বৌদ্ধ বিহারের উপর হামলা করা হয়েছিলো। এর আগেও বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিকের ফান ম্যাগাজিনে একটি ব্যঙ্গাত্নক কার্টুন ছাপা হওয়ার প্রতিবাদে এ ধরণের জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিলো যা আদালতের সিদ্ধান্তে স্তিমিত হয়, কিন্তু বর্তমান অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির সাথে নতুন এই বিতর্কটি যোগ হওয়ায় ব্যাপক রক্তপাত ও প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে।

ব্লাসফেমি বা ধর্মবিশ্বাসে আঘাত কি?

ব্লাসফেমি শব্দটি গ্রীক ‘ব্লাসফেমেন’ থেকে এসেছে,যার অর্থ দাড়ায় কারো উপর অপবাদ বা কলঙ্ক আরোপ করা বা সম্মানে আঘাত করা। তবে ব্লাসফেমি বলতে প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় বিশ্বাস বা প্রতীকের প্রতি অসম্মান প্রদর্শনকেই বোঝানো হয়। কোন ব্যক্তি এইসব অপরাধ করলে যে আইনে তার বিচার করা হয়,সেটাকেই বলা হয় ব্লাসফেমি আইন। ব্লাসফেমি আইনের সর্বপ্রথম উদ্ভব ঘটেছিলো মধ্যযুগের ইউরোপে, কিন্তু বর্তমান বিশ্বে ব্লাসফেমি অত্যন্ত বিতর্কিত একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুক্ত চিন্তা আর বিবেকের স্বাধীনতার ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণে অনেক দেশই তাদের পূর্বপ্রচলিত ব্লাসফেমি আইনগুলোকে ক্রমশ শিথিল করে ফেলছে। তবে কিছু দেশে এখনো এর প্রয়োগ বিদ্যমান আছে,যেমন পাকিস্তানে দণ্ডবিধির ২৯৫ ধারা সংশোধনের মাধ্যমে ব্লাসফেমি অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত উন্নীত করা হয়,এছাড়া আফগানিস্তানেও ব্লাসফেমি আইন রয়েছে যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত “ব্লাসফেমার” হলেন ইরানের সালমান রুশদী, সত্তর দশকে স্যাটানিক ভার্সেস লেখার জন্য যার বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারী করেছিলেন ইমাম খোমেনী। আবার অনেক ক্ষেত্রে ধর্মীয় মূল্যবোধের খুব সূক্ষতম পর্যায়ে গিয়েও ব্লাসফেমির অভিযোগ আনা হয়, যেমন মালয়েশিয়াতে যোগ ব্যায়াম কিংবা সোমালিয়াতে গান শোনা বা সিনেমা দেখাও ব্লাসফেমির অন্তর্ভুক্ত।

ইসলামি আইনের প্রধাণতম উৎস কুরআন মাজীদে আল্লাহ ও তার রসূলের প্রতি অবজ্ঞা ঠাট্টা বা মশকরা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকতে বিশ্বাসীদের কঠোরভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু লক্ষণীয় যে,একে তাৎক্ষনিক ভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি,বরং বলা হয়েছে কেয়ামতের দিন স্বয়ং আল্লাহ পাক এসব অপরাধের বিচার করবেন। এছাড়া মুমিনদের পরামর্শ দেয়া হয়েছে,এইধরনের কিছু শুনলে বা দেখলে প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন না করতে। সূরা আন নিসায় বলা হচ্ছে,

“আর কোরআনের মাধ্যমে তোমাদের প্রতি এই হুকুম জারি করে দিয়েছেন যে, যখন আল্লাহতালার আয়াতসমূহের প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন ও বিদ্রূপ হতে শুনবে, তখন তোমরা তাদের সাথে বসবে না,যতক্ষণ না তারা প্রসঙ্গান্তরে চলে যায়”

বাংলাদেশী আইনে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের শাস্তি ও সীমাবদ্ধতা

সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। এছাড়া ৩৯ এর ২(ক) ও ২(খ) অনুযায়ী বাকস্বাধীনতা আর সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ব্যাপারে উল্লেখ করা আছে। তবে কথা বা লেখার মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা বা ধর্মীয় কোনও প্রতিষ্ঠানের ক্ষতিসাধন করা বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ২৯৫ ও ২৯৫(ক) অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। উক্ত দুই ধারার অধীনে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও জরিমানার বিধান আছে। এছাড়া ফৌজদারী কার্যবিধির ৯৯ (ক) ধারা অনুযায়ী সরকার এই ধরণের যেকোনো প্রকাশনা বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা রাখে। বাংলাদেশে সর্বশেষ ব্লাসফেমির অপরাধে বিচার হয়েছিলো ২০০৭ সালে,ধর্মীয় উস্কানিমূলক কার্টুন প্রকাশের দায়ে সেসময় কার্টুনিস্ট আরিফুর রহমানকে দুই মাসের জেল এবং ৫০০ টাকা জরিমানা প্রদান করা হয়েছিলো।

তবে অবাধ তথ্য প্রবাহের এই যুগে সাইবারস্পেসে বিশেষত ফেসবুক ও ব্লগে বিভিন্নভাবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া এবং খুব সহজেই জনমত গঠন বা উস্কে দেয়ার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে যায়। এমনকি উস্কানিদাতা অবমাননাকারী ব্যক্তি বা গ্রুপ পরবর্তীতে সহজেই সেই পোষ্ট ডিলিট করে দিয়ে নিরাপদ থাকবার সুযোগ পায়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের আইন কোন তাৎপর্যপূর্ণ সুরক্ষা এখনও নিশ্চিত করতে পারেনি। বাংলাদেশের সাইবার জগতের নিয়ন্ত্রক একমাত্র আইন – তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ এর ৫৭ ধারা অনুসারে, যদি ইন্টারনেটে কোন ব্যক্তির কোন লেখা “রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানী প্রদান করে” তাহলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং এই কাজের সর্বোচ্চ  শাস্তি হিসেবে দশ বছর কারাদন্ড এবং অনধিক “এক কোটি টাকা” জরিমানা প্রদানের বিধান রাখা হয়েছে। পরিস্থিতির ভয়াবহতার সাপেক্ষে এই শাস্তি যথোপযুক্ত মনে হলেও আইনের সবচেয়ে বড় গলদটি রয়ে গেছে সরকারেরই হাতে। আইনের ৬৮ ধারায় বলা হয়েছে যে এই আইনের অধীনের সংঘটিত অপরাধের বিচার কেবলমাত্র সাইবার ট্রাইবুন্যালেই হতে হবে যার গঠন করার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ কোন সাইবার ট্রাইবুন্যাল গঠন করা হয়নি। অবশ্য আইনের ৭৪ ধারায় যতক্ষন ট্রাইবুন্যাল গঠিত না হচ্ছে, ততক্ষণ বিচারের দায়িত্ব ফৌজদারী আদালতের হাতে দেয়া থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ফেসবুক স্ট্যাটাস সংক্রান্ত বেশ কিছু মামলা হয়েছে, যা মূলত হাইকোর্টের কোন বেঞ্চের স্ব-প্রনোদিত রুলের মাধ্যমে জারী ও নিস্পত্তি করা হয়েছে।

শেষ কথা

বর্তমান বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে স্বাধীন মতপ্রকাশ আর মুক্তচিন্তার ধারনা ক্রমশ বিকশিত হচ্ছে, তাই ব্লাসফেমি আইনের বিস্তৃতিও ধীরে ধীরে কমে আসছে। তবে মনে রাখতে হবে,মুক্তচিন্তা মানে যা খুশি তাই বলার স্বাধীনতা নয়,অপরের বিশ্বাসে আঘাত হানার নামও বাক স্বাধীনতা নয়। আবার, একটি রাষ্ট্রে ব্লাসফেমি আইন যেন কোনোভাবেই নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে হিসেবে ব্যবহৃত হতে না পারে,অথবা প্রকৃতার্থেই মুক্তচিন্তার পথকে রুদ্ধ করতে না পারে তার নিশ্চয়তা বিধান করা প্রতিটি গণতান্ত্রিক সরকারের দায়িত্ব। তবে সাম্প্রতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সাইবারস্পেসে বাকস্বাধীনতা এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মধ্যে একটি সুস্পষ্ট সীমারেখা টানা দরকার। বিভিন্ন সময়ে আবেগকে পুজি করে সংখ্যালঘু মানুষের উপর আঘাত হানা হয়, যার ফলে সামগ্রিকভাবে বিপন্ন হয় মানবতা ও মানবাধিকার।