মাসকয়েক আগে দেশব্যাপী আলোড়ন তোলা উচ্চশিক্ষায় ৭.৫% ভ্যাট প্রত্যাহার আন্দোলনের সফলতার কথা মনে থাকবার কথা সবারই। এও মনে থাকবার কথা, সেই আন্দোলনের ফলে সরকার উচ্চশিক্ষায় ভ্যাট বাতিলের সাথে সাথেই প্রযুক্তিখাতে ৪% ভ্যাট আরোপ করেছিল। অবশ্য যুক্তি তো আছে, চল্লিশ হাজার টাকায় ল্যাপটপ কিনতে পারলে মাত্র ১৬০০ টাকা ভ্যাটও দিতে পারবেন, এ আর এমন কি কঠিন !
তবে আমাদের জন্য সবচেয়ে আশংকার যে বিষয়, সেটি হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে টিকফা চুক্তির প্রয়োগ…… এই চুক্তির আওতায় আমাদের কর্তৃপক্ষ মার্কিন কোম্পানীগুলোর ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি রাইটস (IPR) বাস্তবায়নে বাধ্য থাকবেন, যদিও উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ২০২১ সাল পর্যন্ত একটা অবকাশ পেয়েছিল। এই সময়সীমা বাড়ানোর সুযোগ আছে, নিজেদের অবকাঠামোগত এবং শিল্প-বাণিজ্যগত উন্নয়ন করবার সুযোগও আছে, কিন্তু তা না করে আমরা মনোযোগ দিয়েছি কিভাবে আগেভাগেই মার্কিন কর্পোরেট জায়ান্টদের ব্যবসা মজবুত করা যায়।
বিষয়টা একদম সহজ করে বলি। সারা বিশ্বের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা WTO এর একটা চুক্তি হলো TRIPS, যাকে বলা হয় Trade Related Aspects of Intellectual Property, অর্থাৎ মেধাস্বত্ব অধিকারের (আইপি) বাণিজ্যিক বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণ। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এখানে ২০২১ সাল পর্যন্ত একটি অবকাশ দেওয়া হয়েছিল, কিছু গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর যেমন ফার্মাসিউটিক্যালসের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব সীমাহীন। আজকে মার্কিন কোন কোম্পানীর একটি উন্নতমানের ঔষধ যদি আমাদের কোন দেশি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ‘কপি’ করেও তৈরি করে, তাতে অসুবিধা নেই অন্তত ২০২১ সাল পর্যন্ত। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এটা এক মহা সুযোগ।
আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হচ্ছে, খুব সম্প্রতি WTO কাউন্সিল তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য এই ট্র্যানজিশন অবকাশ বাড়িয়ে ২০৩২ সাল পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বিশেষ করে ওষুধপত্রের ক্ষেত্রে আইপি অধিকার (যেমন প্যাটেন্ট) কি ধরণের ক্ষতি বয়ে নিয়ে আসতে পারে, তার সাম্প্রতিক উদাহরণ আমাদের সামনেই আছে। ক’দিন আগেই মার্কিন এক ধনকুবের মার্টিন শিরেলি তার কোম্পানি Turing Pharma এর মাধ্যমে এইচআইভি/এইডস এর একটি আধুনিক ওষুধ ডারাপিম এর প্যাটেন্ট কিনে নেন, এবং সাথে সাথেই এর দাম ৫০০০% বাড়িয়ে দেন। এই ওষুধটি আগে বাজারে ট্যাবলেট প্রতি ১৩.৫০ ডলারে পাওয়া যেত, প্যাটেন্ট অধিকার পাবার পর এর দাম হয়ে গেল ট্যাবলেট প্রতি ৭৫০ ডলার ! সারা বিশ্বে এর তুমুল সমালোচনা হলেও আইনের হাত এখানে বাঁধা, আইপি অধিকারের বলে এখানে কারো কিছু করার নেই।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো ২০২১ সাল পর্যন্ত TRIPS এর এই অবকাশ সুবিধাটা পেলেও একটি জায়গায় কেবল এই সুবিধা খাটবে না, সেটা হচ্ছে – যদি উন্নয়নশীল এই দেশের সাথে অন্য কোন দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি থাকে। দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশের সাথে ইউরোপের European Union – Bangladesh Cooperation Agreement on Partnership and Development, 1999 চুক্তি এবং আমেরিকার US – Bangladesh Bilateral Investment Treaty 1989 চুক্তি বলবত আছে, যা আমাদেরকে TRIPS এর অবকাশ সুবিধা নিতে বাঁধা দিচ্ছে। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে এখন যুক্ত হয়েছে টিকফা চুক্তি।
সহজ বাংলায়, এখন থেকে অ্যামেরিকান (মাইক্রসফট অ্যাপল থেকে শুরু করে সব) ‘চোরাই’ পাইরেটেড সফটওয়্যার না চালিয়ে হাজার দশেক টাকা দিয়ে অরিজিনাল উইন্ডোজ সহ অন্যান্য সকল সফটওয়্যার ন্যায্যমূল্যে খরিদ করিতে বাধ্য থাকিবেন। বিদেশের প্যাটেন্ট করা ঔষধ উচ্চমূল্যে কিনে খেতে হবে। কৃষিক্ষেত্রে বহুজাতিক বীজ কোম্পানীগুলোর আগ্রাসনে কৃষকেরা তাদের স্বাধীনতা হারাবে, আর পয়সার জোরে আমাদের চিরায়ত কৃষিজ সম্পদগুলোর স্বত্ব নিয়ে নেবে সেইসব কোম্পানী।
সর্বশেষ বিনোদন, টিকফা চুক্তির ১৫ নম্বর প্রস্তাবনা অনুসারে – মার্কিন বিনিয়োগকারীদের অর্জিত মুনাফা বা পুঁজির ওপর বাংলাদেশ কোন কর আরোপ করতে পারবে না এবং বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেয়া হলে তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এর আগেও ভিনদেশকে ট্র্যানজিট বা করিডোর দেওয়া হয়েছে, অসভ্যতা বা বেয়াদবি হবে বলে সেখানে কোন শুল্ক রাখা হয়নি। মোবাইল কোম্পানীগুলো দুই হাজার কোটি টাকার কর ফাঁকি দিয়েছে। যাবতীয় ভ্যাট-ট্যাক্স শুধুমাত্র বাঙ্গাল জনগোষ্ঠীর জন্য।
আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশ কিন্তু বিশ্বব্যাংকের হিসেব অনুসারে এখন নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে, অর্থাৎ বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১০৭৪-৪১২৫ ডলার ব্র্যাকেটের মধ্যে চলে এসেছে। আমাদের উন্নয়ন এবং প্রবৃদ্ধির হার গত ক’বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর এখন মোটামুটি স্টেবল এবং সম্ভাবনাময় বলা চলে, অর্থাৎ আগামী বছর পাচেকের মধ্যেআমাদের মাথাপিছু আয় আরও বাড়তে থাকলে স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটেগরী থেকে এর পরবর্তী ধাপে যদি উন্নীত হয়ে যাই, তখন TRIPS এর ছাড়গুলো আমাদের জন্য এমনিতেই প্রযোজ্য হবে না।
এখন, এই অবস্থায় করণীয় কি?
প্রতিবেশী ভারতের উদাহরণ এখানে আমাদের বুঝতে কিছুটা সহযোগিতা করবে। ভারত তার আইনি কাঠামো এবং বিচার ব্যবস্থাকে জনবান্ধব করে তুলে বহুজাতিক কোম্পানির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অনেকটা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে বলা চলে। ২০১৩ সালে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তৈরি করা এক রায়ে ভারত Nexavar নামক কিডনি রোগীদের একটি জরুরী ঔষধের ওপর থেকে এর প্রস্তুতকারক জার্মান কোম্পানি Bayer AG এর আইপি দাবী জনস্বার্থে উঠিয়ে নিয়েছে। (আইনের ভাষায় একে বলা হয় Compulsory License), এবং দেশীয় এক ঔষধ কোম্পানিকে সেই ঔষধ বানাবার অনুমতি দিয়েছে। জার্মান কোম্পানির তৈরি ওষুধের দাম যেখানে ছিল প্রায় ২,৮০,০০০ রুপি, ভারতের নিজস্ব কোম্প্যানি ন্যাটকো ফার্মা সেই ওষুধ দিতে পারছে মাত্র ৮,৮০০ রুপিতে।
ঠিক একই ধারার আরেকটি মামলায় ২০১৩ সালেই গ্লোবাল ফার্মা জায়ান্ট নোভার্টিসের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে ভারতীয় আদালত। Gleevecনামের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি ওষুধের দাম নোভার্টিস যেখানে রাখতো ২৬৬৬ ডলার, সেই ওষুধ ন্যাটকো ফার্মা দিচ্ছে স্রেফ ১৭৭ ডলারে।
সম্প্রতি জাতিসংঘের জেনারেল অ্যাসেম্বলি’তে তৃতীয় বিশ্বের নেতা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে বাংলাদেশ। পুঁজিবাদী অর্থনীতির ধারক-বাহক বড় দেশগুলো এবং তাদের রক্তচোষা বহুজাতিক কোম্পানির বিরুদ্ধে কিছু করবে কি বাংলাদেশ?
২০১৫ সালে জাতিসংঘের মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল এর পরিসমাপ্তি হবার পর এবার ২০১৫-২০৩০ সালের জন্য নেয়া হয়েছেসাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস, যার ৩য় গোলটি হচ্ছে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। জনস্বাস্থ্য এবং ঔষধ খাতে আমাদের ভঙ্গুর আইনি সুরক্ষা এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতা এই লক্ষ্য পূরণে কতটুকু সহায়ক হবে তা বনলা খুবই কঠিন।
এখনকার বাংলাদেশী তারুণ্যের মধ্যে একটা প্রবণতা প্রায়ই দেখতে পাচ্ছি, মার্কিন বিলিয়নিয়ারদের আইকন বানিয়ে তাদের জীবন-দর্শন পূজা করা। চকচকে পোশাকে বহুজাতিক কোম্পানীর দাসত্ব করবার চেয়ে উদ্যোক্তা হওয়া অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু উদ্যোক্তা হয়ে যদি দেশে ব্যবসাই না করা যায়, তাহলে লাভ কি?
গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া আর কাউকেই এই টিকফা বা এইধরণের চুক্তি নিয়ে কথাবার্তা বলতে দেখছি না। ইকোনমিক সাম্রাজ্যবাদের এই দাসত্ব গলায় নিয়ে নিচ্ছি আমরা, জেনে কিংবা না জেনেই।
তবে, খেসারত দিতে হবে আমাদের সবাইকেই।