অসম্ভব অত্যাচারী স্বামীর কাছ থেকে দূরে সরে এসেছিলেন পেরুভিয়ান তরুণী র্যাকুয়েল। স্বামী আর কি করবেন…… ক্ষমা চেয়ে, মন ভোলানো চিঠি লিখে তাকে আবারও কাছে ডেকে নিয়ে যান। শত হলেও নারীর মন, ক্ষমা করে দিতেই ভালোবাসে। কি ছিল সেই চিঠিতে ?
‘কথা দিচ্ছি, এমনটি আর হবে না। আমি জানি তুমি আস্থা হারিয়েছ আমার ওপর, কিন্তু আমি বলছি, যে আমি ভুল করেছিলাম। চাই না আমাদের এই সুন্দর সম্পর্কে কোন ছেদ আসুক। তুমি আমার জীবনের সব, আমি তোমাকে প্রচন্ডভাবে ভালোবাসি। ক্ষমা করো আমায়’
ভালোবাসার মানুষটির কাছে শেষ পর্যন্ত ফিরে গিয়েছিলেন তিনি। তবে এই চিঠিটা পড়বার পাঁচ সপ্তাহের মাঝেই র্যাকুয়েল স্বামীর কাছ থেকে জীবনের সর্বশেষ ‘আঘাত’টি পান; যার বদৌলতে এই মুহূর্তে তিনি চিরনিদ্রায় ঘুমোচ্ছেন ভিয়া মারিয়া সেমিট্রিতে।
শুধু র্যাকুয়েলই নন, গত দশ বছরে পেরুতে প্রায় ৭০০ জন নারী পারিবারিক সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন। সেটা প্রতিরোধ করবার চেষ্টা থেকেই পেরু’র এক এনজিও ‘ভিদা মুহের’ (নারীর জন্য জীবন !) এই দুর্দান্ত মর্মস্পর্শী বইটি বের করেছে, যার নাম Don’t Die For Me – আমার জন্য মরো না। (বইটা স্প্যানিশ ভাষায় লিখা)
পারিবারিক পরিমণ্ডলে নারী নির্যাতন বা আমাদের খাস বাংলায় ‘বৌ পেটানো’ কাজটা পৃথিবীর অনেক দেশের পুরুষদেরই একটা প্রিয় হবি। বছর দশেক আগে WHO সেরা দশ বৌ/ নারী পেটানো দেশের একটা তালিকা করেছিল, সেখানে পেরু, ব্রাজিল, ইথিওপিয়া, জাপান, নামিবিয়া, সামোয়া, সার্বিয়া ও মন্টেনেগ্রো, থাইল্যান্ড এবং তাঞ্জানিয়ার সাথে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের নামও ছিল।
Don’t Die For Me বা ‘আমার জন্য মরো না’ এমন একটি বই যেখানে পেরুর ২৫ জন নির্যাতিত নারীর গল্প তুলে ধরা হয়েছে। দুই ভাগে ভাগ করা বইটা – সাদা এবং কালো রঙের পৃষ্ঠায়। সাদা অংশে আছে ২৫টি প্রেম নিবেদনঃ হাতে লিখা চিঠি, মোবাইল টেক্সট এবং ই-মেইলের স্ক্রিনশট…… উপচে পড়া আবেগ আর ক্ষমা প্রার্থনার ভাষায় কি নেই সেখানে ! সমস্যা হলো, এই ২৫টা প্রেম নিবেদন এসেছে চরম নির্যাতনের পর যখন নারীটি তার স্বামী বা বন্ধুকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, সেই সময়ে বিরহকাতর প্রেমিকদের ক্ষমাপ্রার্থনা হিসেবেই। নির্যাতিত হওয়ার পরও কোমল হৃদয়ের নারীরা তাদের ভালবাসার মানুষের কথায় বিশ্বাস করেছিলেন, ফিরে এসেছিলেন তাদের পুরুষদের কাছে।
দুর্ভাগ্য, তাদের প্রত্যেককেই সেই বিশ্বাস আর ভালোবাসার চরম মূল্য দিতে হয়েছে।
বইটার দ্বিতীয় অংশ কালো রঙের, সেখানে লিখা আছে এই ২৫ জন নারী ফিরে আসাবার পর কি সমাদর লাভ করেছিলেন। না, র্যাকুয়েলের মত সবাই অবশ্য মারা যান নি, চরম নির্যাতনের চিহ্ন সারা দেহে-মনে বয়ে নিয়ে আজও হয়তো বেঁচে আছেন কেউ কেউ। তবে স্বপ্নের মৃত্যু হয়েছে তাদের সবারই।
যেমন ধরুন আরেক হতভাগিনী কার্লার কথা। স্বামীর নির্যাতনে টিকতে না পেরে যখন তিনি আলাদা হয়ে যান, তখন স্বাভাবিকভাবেই উথলে ওঠে স্বামীপ্রবরের ভালোবাসা। ই-মেইল বলছে –
‘তুমি জানো আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি, আমি ভুল করেছি, আমাকে ক্ষমা করা প্রিয়া’।
প্রিয়া তাকে ক্ষমা করেছিলেন, গর্ভে আসা অনাগত সন্তানটার কথা ভেবেই হয়তো বা ফিরেও এসেছিলেন স্বামীর কাছে। চরম নির্যাতনে গর্ভপাত তো ঘটেই, আজীবনের জন্য সন্তান ধারণ ক্ষমতাও হারান এই নারী।
এভাবে একে একে সুজান, আন্দ্রেয়া, ভ্যালেরিয়া, নাতালিয়া সহ ২৫ জন নির্যাতিতা নারীকে মনভোলানো প্রেম এবং এর পরবর্তী নারকীয় নির্যাতনের গল নিয়ে সাজানো হয়েছে ছোট্ট এই বইটি।
ল্যাটিন আমেরিকার কথা বাদ দিলাম, আমাদের নিজের পরিমণ্ডলেই এই দৃশ্য খুবই সাধারণ। অনেক জল্পনা কল্পনা আলোচনার পর আমাদের পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে আইন হয়েছে ২০১০ সালে। আর তার পাঁচ বছর পর আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যানে ২০১৫ সালের অবস্থানটা আসুন একটু দেখে নেই (স্রেফ পারিবারিক সহিংসতা, অন্য কোন নারী নির্যাতন নয়)।
মনে রাখতে হবে, এই রিপোর্ট বা পরিসংখ্যান কিন্তু শুধু যে সব খবর পত্রিকায় আসে, তার ওপর ভিত্তি করে তৈরি। আর পারিবারিক সহিংসতার যে কোন মাত্রার নির্যাতনই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চাপা পড়ে থাকে, এ বিষয়ে কারো সন্দেহ আছে কি ? ধরুণ যদি পেরুর মত আমরাও যদি একটা বই লিখতে বসি,পারিবারিক নিরাপত্তার মধ্যে আমাদের ‘নির্যাতিত’ বোন-মেয়ে-প্রিয়তমাদের জন্য, বিষয়টা খারাপ হয় না নিশ্চয়ই। তবে মাথায় রাখতে হবে, ‘বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না‘ প্রবাদটা বাঙ্গাল মুলুকের বাইরে আর কোথাও প্রচলিত আছে কি না আমার জানা নেই।
তারপরেও যে তথ্য বেরিয়ে আসবে, ২৫ হাজার গল্পেও তার সংকুলান হবে কি না কে জানে।
পেরুর পরিসংখ্যান ছিল দশ বছরে সাতশো নারীকে হত্যা, আইনের ভাষায় এই অপরাধের নাম ‘ফেমিসাইড’, নারী হত্যা। তার পরিপ্রেক্ষিতে বের করা হলো এই কাঁপিয়ে দেওয়া বই, যার ইমপ্যাক্ট ছিল সারা পৃথিবীজুড়েই। ভিদা মুহের এই বইটি প্রকাশ করে একটি আবেদনই রেখেছিল, আমাদের বইয়ের আরেকটি গল্পের পাতা হয়ে যাবার আগেই আমাদের কাছে সাহায্যের জন্য চলে আসুন। ২০১৫ সালের এপ্রিলে বইটি প্রকাশের পর থেকে এখনও অবধি প্রায় হাজার দুয়েক নারী ছুটে এসেছেন তাদের কাছে, সাহায্য নিয়েছেন নতুন জীবনের জন্য।
আর আমাদের স্রেফ ২০১৫ সালেই পারিবারিক সহিংসতায় মারা গিয়েছেন ২১২ জন (তাও পত্রিকার হিসেবে)। আমাদের ‘জাগো গো ভগিনী’রা, তাদের ভাই-বাবা-স্বামীরা একটু জাগবেন কি ? সন্তান বা জীবন-জীবিকার জন্য সকল নির্যাতনেও মুখ বুজে থাকা গ্রামের সহজ সরল মেয়ে কিংবা শহরের দাঁতে দাঁত চেপে থাকা শিক্ষিত মেয়ে, কিংবা বৃদ্ধা মা বা চিরশত্রু শাশুড়ি সম্প্রদায়ের কেউ……… এদের সবার অব্যক্ত কষ্টটুকু নিয়ে কথাবার্তা যদি না হয়, তাহলে স্রেফ ধর্মীয় মৌলবাদ, হিজাবের তান্ডব (?!) আর ফতোয়াবাজদের মুন্ডূপাত করে নারী অধিকার বাস্তবায়ন করাটা হয়তো খুব গ্ল্যামারাস দেখায়, কিন্তু আলোর নিচে অন্ধকার দূর হয় না।
একজন মা যখন পরিবারে নির্যাতিত হন, তার অক্ষম সন্তানের নির্বাক কান্নার চেয়ে বড় নালিশ আর কিছু আছে কি ?
————————-