একজন মানুষ যদি চিন্তায়-মননে-কাজে তার যুগের চেয়ে অগ্রগামী হয়, তাহলে তা পরিণতি কি হতে পারে?
অনেক কিছুর মাঝে নিশ্চিতভাবেই দু’টো ঘটনা ঘটতে পারে – হয় সেই সমাজ তাকে জয়মাল্য গলায় দেবে, অথবা ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিবে। এইরকম কিছু ইতিহাস কাঁপানো বিচার উঠে এসেছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কলমে, আজকের যুগে আমাদের আইন এবং মূল্যবোধ সাপেক্ষে যেগুলোকে মূলত অবিচারই বলা চলে। এটি এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলবার মত অসাধারণ একটি বই, যেখানে উপন্যাসের মত ঝরঝরে ভাষায় আড়াই হাজার বছর ব্যাপী আইন-আদালত-অবিচার এবং ‘আদালতের ঘাড়ে বন্দুক’ রেখে পাখি শিকারের সেই পুরনো সংস্কৃতিই বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে। ব্যবধান হচ্ছে – এখানে কাঠগড়ায় দাঁড়াচ্ছেন ক্ষণজন্মা কিছু মানুষ, যারা ছিলেন তাদের যুগের চেয়ে অনেক অনেক বেশি এগিয়ে।
সাধারণত আমরা আদালতে অন্যায় বিচারের যেসব নমুনা প্রত্যক্ষ করে থাকি, সেখানে বিপ্লবী, রাজনৈতিক নেতা, স্বাধীনতাযোদ্ধা রাফ এন্ড টাফ মানুষদের বীরত্বের বিবরণই দেখে আমরা অভ্যস্ত। এই বইটির একটি বিশেষ দিক হচ্ছে, সুনীল নিজে সাহিত্যিক বলে তিনি কাঠগড়ায় দাঁড়ানো দার্শনিক-শিল্পী-সাহিত্যিকদের কষ্ট এবং লড়াইয়ের ছবিটুকু উঠিয়ে এনেছেন নিপুণভাবে, যাদেরকে সাধারণত আমরা কোমল ও সংবেদনশীল হৃদয়ের মানুষ হিসেবেই জেনে থাকি।
কেমন ছিল অবিচারের মুখে দাঁড়িয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া?
সক্রেটিস এবং যীশুঃ অপরাধ যখন আদর্শ
যুবসমাজকে নষ্ট করছেন তিনি, তাদের আত্না বিষাক্ত করছেন সক্রেটিস – এই ছিল অভিযোগ। স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের মডেলে উঠে আসা প্রাচীণ এথেন্সের প্রাজ্ঞজনেরা তাই মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন সক্রেটিসকে, এ ইতিহাস আমরা সবাই জানি। আরও জানি মৃত্যুদন্ড দেবার সময়ে সক্রেটিসের সেই অমর বক্তব্য, প্লেটোর লিখনীতে ‘দ্য অ্যাপোলজী’ নামে যা এখনও আলোড়িত করে পাঠককে। (যদি আপনি তা পড়ে না থাকেন, শক্ত এবং ঋজু এই বক্তৃতাটুকু পড়ে নেবেন দয়া করে, সুনীল তার বইয়ে খুব প্রাঞ্জলভাবে তা তুলে এনেছেন)। সক্রেটিসের সে শেষ বক্তব্যটুকু মনে দাগ কাটবে সবার –
‘আমি চলেছি মৃত্যুর পথে, আপনারা চলেছেন জীবনের পথে। কোন পথ সঠিক, তা ঈশ্বরই জানেন।’
একই ভাবে যীশু (হযরত ঈসা (আঃ)) এবং তার অন্যতম সহচর জন দ্য ব্যাপটিস্ট (ইসলামে যাকে আমরা নবী ইয়াহিয়া (আঃ) বলে জানি) এর মর্মন্তুদ পরিণতির কথাও আমরা সবাই জানি। ধর্মীয় নানা বিবরণীর পাশাপাশি এই নৃশংসতার কিছু ছবি অস্কার ওয়াইল্ডের ‘সালোমি’ নাটকে উঠে এসেছে। সুনীল দেখিয়েছেন, কিভাবে ঈসার প্রতি অনুরক্ত জেরুসালেমের রোমান শাসক পন্টিয়াস পাইলেট তাকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু রক্তের নেশায় উন্মাদ ইহুদী লোকেরা চাপ দিয়ে তার মৃত্যুদন্ডাদেশ বের করে এনেছিল। এক পর্যায়ে পাইলেট প্রশ্ন করেছিলেন, এই হত্যাকান্ডের পাপের দায় তারা নিতে প্রস্তুত কি না? তখন সমবেত ইহুদীদের উত্তরটা ছিল – হিজ ব্লাড বি অন আস, এন্ড আওয়ার চিলড্রেন।
এই রক্তের দায় থেকে জায়নবাদী ইহুদীরা এখনও বের হতে পারেনি।
জোয়ান অফ আর্ক
পনেরো দিন ধরে ষাট জন বিচারক খুচিয়ে খুচিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন তরুনীটিকে, এবং কোন আইনজ্ঞ বা অন্য কারো সহায়তা ছাড়াই একাই সেইসব প্রশ্নবাণ মোকাবেলা করে যাচ্ছিল জ্যানেট নামের অষ্টাদশী তরুণিটি, জোয়ান অফ আর্ক নামে সারা বিশ্ব যাকে জানে। অভিযোগ? সে ডাইনি, ব্যভিচারিণী এবং পুরুষের পোশাক পরে !
ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডের সেই শতাব্দি প্রাচীণ যুদ্ধ আর বিরোধের ইতিহাসে দুর্বল ফরাসী রাজা সপ্তম চার্লসের ভগ্ন দরবারে যেন দেবদূতের মতই উদয় হয় এক গ্রাম্য অশিক্ষিতা মেয়ে, দাবী করে রাজার সেনাদলের দায়িত্বভার তার হাতে তুলে দেবার জন্য। আর এরপর তার অবিশ্বাস্য নেতৃত্ব আর রণকৌশলে একে একে পরাজিত হতে থাকে ইংরেজ বাহিনী, ফ্রান্সের সিংহাসনে শক্তভাবে আসীন হন রাজা সপ্তম চার্লস।
এরপর ইংরেজ সমর্থিত বার্গান্ডিয়ান ফরাসীরা সুযোগ পেয়ে জোয়ানকে বন্দি করে এবং ইংরেজদের কাছে বিক্রি করে দেয়। ইংরেজদের দখলকৃত ফ্রান্সের নরম্যান্ডিতে তার বিচার শুরু হয়। বিচারে জোয়ানকে ডাইনি সাব্যস্ত করা হয় এবং ১৪৩১ সালের ৩০ মে প্রকাশ্যে প্রায় ১০ হাজার মানুষের সামনে তাকে পুড়িয়ে মারা হয়। সেই বিচারে জোয়ানের জবানবন্দী উঠে এসেছে সহজ সরল ধর্মভীরু একজন মেয়ের নির্ভীক স্বীকারোক্তি। এই স্বীকারোক্তির শেষ বক্তব্য ছিল, ঈশ্বরের ইচ্ছা হলো ইংরেজরা ফ্রান্স ছেড়ে চলে যাক!
জোয়ানের মৃত্যুর পর খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি, ইংরেজরা ফ্রান্স থেকে পালাতে বাধ্য হয়। ২৫ বছর পর ১৪৫৫ সালে পোপ ক্যালিস্টাস জোয়ান অফ আর্কের বিচারের নথিপত্র তলব করেন এবং পুনঃতদন্তের নির্দেশ দেন। খুব সহজেই উঠে আসে কিভাবে বিচারের নামে তাকে হত্যা করা হয়েছে। এই বিচারের প্রধাণ পান্ডা বোভের বিশপের কঙ্কাল কবর থেকে উঠিয়ে এনে নর্দমায় ফেলে দেয়া হয়।
জিওর্দানো ব্রুনো এবং গ্যালিলিও গ্যালিলিঃ ধর্ম যখন সত্যের গলা চেপে ধরে
জগৎবিখ্যাত জ্যোতির্বিদ নিকোলাস কোপারনিকাসের শিষ্য জিওর্দানো ব্রুনো বিশ্বাস করতেন মহাবিশ্ব প্রতিনিয়ত সম্প্রসারণশীল, এর কোনো সীমা নেই। তিনি কোপারনিকাসের সূর্য কেন্দ্রিক মহাজাগতিক তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি সমাজের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কথা বলতেন, পরিবর্তনের কথা বলতেন। ধীরে ধীরে তিনি সাধারণ মানুষের কাছে ভীষণ জনপ্রিয় হতে থাকেন, এবং অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়া হিসেবে ধর্মীয় যাজকদের বিরাগভাজন হন। তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয় এবং ১৫৯২ সালে ভেনিস থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয় তাকে। সুদীর্ঘ সময় তার বিচারকাজ চলে এবং ১৬০০ সালে তাকে আগুন পুড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। কারাগারে ব্রুনোর বলিষ্ঠ উচ্চারণই প্রমাণ করে পাগলাটে লোকটির কতটা সাহস ছিল –
‘শাস্তির কথা শুনে আমি যতটা ভয় পেয়েছি, তার চেয়ে বেশি ভয় পেয়েছো তোমরা, যখন করুণাময় ঈশ্বরের নাম করে তোমরা এই বিচারের বাণী উচ্চারণ করছো।’
ক্ষ্যাপা এই দুঃসাহসী বিজ্ঞানীর ব্যক্তিজীবন কেমন ছিল? জেমস জয়েস তার ‘ফিনিগানস ওয়েক’ উপন্যাসে ব্রুনোর ব্যক্তিজীবনের ছবি একেছেন।
একই পথের পথিক ছিলেন গ্যালিলিও গ্যালিলি, যদিও বয়সের ভারে তার লড়াইয়ের সাহস ও সক্ষমতা কমে গিয়েছিল। ৭০ বছর বয়স্ক এই বিজ্ঞানীকে যখন আদালতে হাজির করা হলো, তার অসাধারণ চিত্রকল্প সুনীল তুলে ধরেছেন বইটিতে। অনেক নাটকের পর ১৬৩৩ সালে তাকে আমাদের ভাষায় ‘যাবজ্জীবন কারাদন্ড’ দেওয়া হলো। বন্দী জীবনে তিনি বেঁচে ছিলেন আট বছর, আর শেষ পাঁচ বছর বেঁচে ছিলেন অন্ধ হয়ে।
‘ধর্মগ্রন্থ ভুল বলে না, কিন্তু যারা এর ব্যাখ্যা করেন, তারাই ভুল বলেন। মানুষের চিন্তা শক্তিকে কে সীমা দিয়ে বাঁধতে পারে? এমন কে আছে যে বলতে পারে, বিশ্ব সম্পর্কে আমি যা জানি তার চেয়ে বেশি আর কিছুই জানার নেই?’ – গ্যালিলিও
ক্রিস্টোফার কলম্বাস এবং স্যার ওয়াল্টার র্যালেঃ দুঃসাহসিক অভিযাত্রার করুণ পরিসমাপ্তি
প্রথম সমুদ্রযাত্রা শেষে যখন স্পেনে ফিরে আসছিলেন কলম্বাস, তখন তাকে বরণ করে নেবার জন্য জাহাজঘাট ছিল লোকে লোকারণ্য। আট বছর পর, তৃতীয় সমুদ্রযাত্রা শেষে যখন হাতকড়া আর শিকলে আবদ্ধ হয়ে ফিরলেন তিনি, তখন তাকে কারাগারে নেবার জন্য প্রহরীরা ছাড়া আর কেউ সেখানে আসেনি। যে রাণী ইসাবেলা তাকে আশীর্বাদ করে পাঠিয়েছিলেন নতুন দেশ আবিষ্কারে, তার সামনেই শৃঙ্খলিত বন্দী হয়ে ক্ষমা চাইতে বলা হল কলম্বাসকে। সুনীল একে বলেছেন বিশ্বের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ততম, আবেগময় বিচার যেখানে শুধু চোখের জলেই কথোপকথন হয়েছিল দোষী এবং বিচারকের মধ্যে।
কলম্বাসের চেয়েও আরও অনেক বেশি জৌলুসপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিল ব্রিটিশ অভিযাত্রী স্যার ওয়াল্টার র্যালে’র। বিশ্ববিখ্যাত চরিত্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে রহস্যময়ী নারী ব্রিটেনের রাণী প্রথম এলিজাবেথ, স্যার ওয়াল্টার র্যালে ছিলেন তার প্রাক্তন প্রেমিক; আরও ছিলেন দুর্ধর্ষ সেনাপতি, কবি, ফ্যাশন আইকন এবং প্রচন্ড অহংকারী একজন ব্যক্তি, একজন প্রবল পুরুষ হিসেবে যাকে রেনেসাঁর শুদ্ধতম বহিঃপ্রকাশ বলে অনেকে আখ্যা দেন ! রানী এলিজাবেথের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল প্রবাদ-প্রতিম, ছুরির ডগায় হীরের টুকরো আটকে কাঁচের ওপর কবিতা লিখতেন এলিজাবেথের জন্য। এমনকি তেপান্ন বছর বয়সী রাণী এলিজাবেথ যখন প্রথম দর্শনেই তার চেয়ে তেত্রিশ বছরের ছোট আর্ল অফ অ্যাসেক্সের প্রেমে পড়েন এবং তার সাথে নির্ঘুম রাত কাটান, সেই মুহূর্তেও দরজার বাইরে পাহারায় ছিলেন ওয়াল্টার র্যালে। কালক্রমে রানীর এই বিশ বছর বয়সী প্রেমিকই তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন, আবার র্যালের হাতেই তার বিয়োগান্তক পরিণতি হয়।
স্প্যানিশ আর্মাডাকে পরাজিত করে আমেরিকা মহাদেশে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর উপস্থিতি জানান দেওয়া হোক, ‘আলু’ নামক জিনিসটা ব্রিটেনে প্রথম আমদানী করে রাণী এলিজাবেথ খাওয়ানোর মাধ্যমে তা সারা ব্রিটেনে ছড়িয়ে দেয়া হোক, কিংবা ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া বস্তু ‘তামাক’ ব্রিটেনে সর্ব প্রথম নিয়ে আসা এবং ধূমপানের প্রচলন করবার মাধ্যমে হোক, ওয়াল্টার র্যালে ছিলেন তার যুগের চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে থাকা একজন মানুষ। আর এ নিয়ে তার অহংকারও ছিল তীব্র। তাই এলিজাবেথের মৃত্যুর পর অযোগ্য ও নিম্নশ্রেণীর সম্রাট জেমস ক্ষমতায় আসীন হয়েই বিচার করেন ওয়াল্টার র্যালের, তক্তার ওপর শুইয়ে কুড়ালের আঘাতে হাত-পা কেটে ফেলে, এরপর পেট চিরে এরপর মুন্ডুপাত, মানে জঘন্যতম নৃশংসতা। এই দন্ড কার্যকর করতে গিয়ে জল্লাদ পর্যন্ত থমকে গিয়েছিল, তক্তার ওপর শুয়ে র্যালে তাকে ধমক দিয়ে কাজ সমাধা করতে নির্দেশ দেন।
মহাকবি দান্তে এবং নিকোলা দস্তয়েভস্কিঃ কলমে উঠে আসা জীবন-মৃত্যুর টানাপোড়েন
বারোশ শতাব্দির নগর রাষ্ট্র ফ্লোরেন্সে তখন ছিল দু’টো দল, যাদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব লেগেই থাকতো সবসময়। এক দল হচ্ছে ঘিবেলিন, যাদের বলা যায় সাদা দল, এরা ছিল নিয়মতান্ত্রিকতায় বিশ্বাসী, কেবলমাত্র ধর্মীয় বিষয় ছাড়া আর কোন কিছুতা পোপের ভূমিকা অস্বীকার করতেনা এনারা। আর এদের বিপরীতে ছিল গালফ, যাদের বলা যায় কালোদল, জীবনের সকল কিছুতে পোপের অন্ধ আনুগত্যই ছিল এদের একমাত্র লক্ষ্য। দান্তে অলিঘিয়েরি ছিলেন ঘিবেলিনদের একজন উঁচুস্তরের সম্মানী ব্যক্তি, যিনি বিচারপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রথম যৌবনে প্রেমে পড়েছিলেন বিয়েত্রিচ নামের অনিন্দ্যসুন্দরী এক তরুণীর, তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে দান্তে কখনো এই ভালোবাসার কথা তাকে জানাননি। বিয়েত্রিচের বিয়ে হয়ে গেল, এক সমুদ্রযাত্রা থেকে এসে বিয়েত্রিচের আকস্মিক মৃত্যুসংবাদও পেলেন দান্তে, কিন্তু ভালোবাসা আটকে রয়ে গেল অন্তরেই।
১৩০১ সালে ক্ষমতাসীন ঘিবেলিনদের দলের পক্ষ হয়ে দান্তে সহ তিনজনের একটা প্রতিনিধি পাঠানো হল ভ্যাটিকানে, পোপের সাথে আলোচনা করে একটা সমঝোতায় আসবার জন্য। কিন্তু এর মধ্যেই গালফদের তুমুল আক্রমণে সম্পূর্ণ বিদ্ধস্ত হয়ে গেল ঘিবেলিন গোষ্ঠী। রোমে বসেই এই পরাজয়ের সংবাদ পেলেন দান্তে। আর পরাজিত পক্ষের মাথা হিসেবে বিচার শুরু হলো তার। অভিযোগ? তিনি ঘিবেলিন দলের লোক, মহা বদমাশ এবং গালফদের জন্য হুমকি! এবার শুরু হলো তার পলাতক জীবন, স্বেচ্ছা নির্বাসন।
আমি জানতে পেরেছি অপরের রুটিতে লবণ মাখালে তার স্বাদ কেমন হয়, এবং অপরের সিড়ি দিয়ে ওঠানামা করা কত কঠিন ! – নির্বাসিত দান্তে
এই টানাপোড়েনের মধ্যে শুরু হলো তার অমর সৃষ্টি, ডিভাইন কমেডি। নিজের জীবনের যাবতীয় দূঃখগাথা কল্পনায় সাজিয়ে তিনি তৈরি করলেন এই মহাকাব্য। এটি মূলত পৃথিবী থেকে তার স্বর্গে আরোহণের গল্প, যেখানে তার পথপ্রদর্শক হিসেবে এসে দাঁড়িয়েছেন রোমান মহাকবি ভার্জিল। প্রথম ধাপ হচ্ছে নরক বা ইনফার্নো, যেখানে দান্তের শত্রুরা সকলে নিজেদের পাপের শাস্তি ভোগ করছে। এরপর পারগেটরি বা শোধনাগার পেরিয়ে তিনি দাঁড়ালেন স্বর্গের দরজায়, তার অপেক্ষায় রয়েছেন প্রেয়সী বিয়েত্রিচ।
বাস্তব জীবনে পরাজিত দান্তে তার নিজের সৃষ্ট জগতের স্বর্গশিখরে উঠে দাঁড়ালেন।
দান্তের মত এত উত্থান-পতনমন্ডিত জীবন ছিল না রুশ সাহিত্যিক ফিওদর দস্তয়েভস্কির। লেখালেখি করতেন, অসম্ভব মেধাবী আর পাগলাটে মানুষ ছিলেন। জার নিকোলাসের বিরুদ্ধে পেট্রাসভস্কি নামের এক লোকের বাসায় সমবেত হয়ে নানারকম বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনায় কল্পনায় হাতি-ঘোড়া মারতেন তারা। তিল থেকে তাল হয়ে এই সংঘেরর কথা চলে গেল জারের কানে। যথারীতি বিচার হলো, শাস্তি মৃত্যুদন্ড। তবে যেহেতু বয়সে তরুণ, তাই সাজা কমিয়ে এনে ৮ বছরের কারাদন্ড দেয়া হলো দস্তয়ভস্কিকে। দলের পান্ডা পেট্রাসভস্কির সাজা হলো যাবজ্জীবন কারাবাস।
জার নিকোলাস ছিলেন খুবই নাটুকে মানুষ, যিনি আড়ম্বর পছন্দ করতেন। তিনি তাদের সাজা আরও কমিয়ে দিলেন, দস্তয়ভস্কির সাজা এসে দাঁড়ালো ৪ বছরে। তবে নিকোলাসের নির্দেশমত তাদেরকে শহরের কেন্দ্রস্থলে নিয়ে ফায়ারিং স্কোয়াডের মাধ্যমে হত্যা করবার জন্য মঞ্চ সাজানো হলো। জারের আজ্ঞা, বন্দীরা যখন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে, ঠিক সে মুহূর্তে তাদের সম্রাটের বাণী শুনিয়ে দেয়া হবে, সম্রাট কিভাবে অসীম দয়ায় তাদের জীবন ফিরিয়ে দিয়েছেন।
দস্তয়েভস্কির লেখা ‘দ্য ইডিয়ট’ উপন্যাসে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া নায়ক মৃত্যুর দু’মিনিট আগে ভাবছিল, কেন এখনও এই সময়টা শেষ হচ্ছে না। অপর দিকে ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’ এ নায়ক ভেবছিল, মৃত্যুদণ্ডের আগের ক্ষুদ্র এই মুহূর্তটুকু যদি অনন্তকাল টিকে থাকতো? বাস্তবে দস্তয়েভস্কি হয়ে পড়েছিলেন অনুভূতিশূন্য। প্রাণভিক্ষা পাবার পরেও তার কোন উত্তাপ-অনুতাপ নেই, কারাবাসের বোঝা মাথায় নিয়ে চলে গেলেন সাইবেরিয়া। সাইবেরিয়ায় বন্দীশিবিরের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে লিখেছিলেন, ‘দ্য হাউস অফ দ্য ডেড’।
জীবনের অসহনীয় উত্থান-পতন আর বিচারের নামে প্রহসনের ফলেই কি আমরা কালজয়ী এই সাহিত্যকর্মগুলো দেখতে পেলাম ?
লর্ড বায়রন, পল গগ্যা এবং অস্কার ওয়াইল্ডঃ ভালোবাসা যখন একমাত্র অপরাধ
‘আমার সম্পর্কে যা কিছু ফিসফাস গুঞ্জন উচ্চারিত হয়েছে, তা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে আমি ইংল্যান্ডের উপযুক্ত নই। আর যদি না হয়ে থাকে, তবে ইংল্যান্ড আমার উপযুক্ত নয়।’
ইংরেজ রোমান্টিসিজমের প্রবাদ পুরুষ লর্ড বায়রন এই কথাটা বলে আদালতকে দুর্দান্ত এক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন। নারীদের প্রতি অসম্ভব কামনার তাড়না অনুভব করতেন তিনি, সবসময়ে, সারাক্ষণ। আর উচ্চবংশীয়া ইংরেজ নারীরাও লাজ-শরম-সংস্কার সবকিছু ভুলে গিয়ে সমর্পিত হতেন বায়রনের হাতে, এই অমিত প্রেমবন্ধনের বিভিন্ন ছবি এঁকে সুনীল দেখিয়েছেন, কিভাবে শারীরিক ভালোবাসা আর কবি প্রতিভা দিয়ে তখনকার ব্রিটিশ অভিজাত মহলে দাগ কেটেছিলেন লর্ড বায়রন, যার প্রভাব পড়েছিল সমসাময়িক তরুণ কবি কীটস এবং শেলির মধ্যেও। পারিবারিক টানাপোড়েনে স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদের মামলায় অবশেষে আদালতের কাছে হার মানতে হয়, কারণ এর সাথে যুক্ত হয়েছিল সারা দেশে তার শত্রু এবং তার ওপর ঈর্ষান্বিত মানুষের ক্ষোভের আগুন। উচ্চবংশের বিবাহিতা কন্যা ক্যারোলিন এবং বায়রনের অম্ল-মধুর-তিক্ত সম্পর্ক পাথরের হৃদয়েও দাগ কাটতে বাধ্য।
‘পৃথিবী গগ্যা’র উপর কোন ছাপ রাখতে পারেনি, বরং গগ্যাই পৃথিবীর ওপর ছাপ রেখেছেন।’
কালজয়ী চিত্রশিল্পী পল গগ্যার ব্যাপারে এই হচ্ছে সুনীলের রায়।
প্যারিসের সাফল্যমন্ডিত সাজানো গোছানো জীবন ছেড়ে হঠাত মাঝবয়সে তার ঝোক উঠলো শিল্পী হবার, সভভ্যতার ধড়াচুড়ো খসে ফেলে জীবনের আদিমতম স্বাদ পাবার। বহু কষ্টে চলে আসলেন পলিনেশিয়ান স্বর্গ রূপ-সৌন্দর্যের রানী তাহিতি দ্বীপে। কুটির বাঁধলেন আদিম অধিবাসীদের সাথে, ঘরে তুললেন পলিনেশিয়ান মেয়েদের। এরপর বহু ভাঙ্গা-গড়া আর দুঃখ অভাবের মধ্য দিয়ে কেটে গেল অনেকগুলো বছর। আরেক প্রবাদপ্রতিম শিল্পী ভ্যান গগের সাথে ঝগড়া লাগলো, যার ফলে নিজের কান কেটে ফেলেছিলেন ভ্যান গগ। এদিকে অনিয়ম আর অনাচারে পল গগ্যার শরীরে বাসা বাঁধলো মরণ রোগ সিফিলিস। হঠাতই যেন বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন শিল্পী, আদিবাসীদের সাথে ফরাসী কলোনিয়ালদের নিপীড়ন আর বৈষম্যমূলক আচরণ নিয়ে তুমুল জোরদার কলাম লিখতে থাকলেন পত্রিকায়। এক পর্যায়ে শরীর ভেঙ্গে আসলো, আর্সেনিক খেয়ে আত্নহত্যার চেষ্টা করলেন তিনি। লাভ হল না, উলটো ভর্তি হতে হলো হাসপাতালে। তার বিছানায় কার্ডে লিখা, ‘পল গগ্যা, ভিখারী’।
এমন অবস্থাতেই তার লেখালেখির প্রতিক্রিয়ার ঝড় আসতে থাকলো। ফরাসী আদালতের সমন জারী হলো, অভিযোগ – শাসকগোষ্ঠীর মানহানি। এই মহা অপরাধের শাস্তি হিসেবে তিন মাসের জেল এবং এক হাজার ফ্রা জরিমানা দেবার রায় চলে এলো। আপীল করে শারীরিক অবস্থার কারণে কারাদন্ড থেকে মুক্তি পেলেও জীবন মুক্তি দেয়নি তাকে, ১৯০৩ সালে মারা গেলেন পল গগ্যা। মৃত্যুর পর তার আঁকা অমূল্য ছবিগুলো পানির দরে নিলামে বিক্রি করে জরিমানার টাকা উসুল করেছিলেন ফরাসী আদালত।
আড়াই হাজার বছর আগে সক্রেটিসের বিচার হয়েছিল, যুবকদের বিপথে পরিচালিত করবার দায়ে। সেই অভিযোগে এবার কাঠগড়ায় দাঁড়ালেন অস্কার ওয়াইল্ড, কারণ তিনি যৌবনের পূজারী, তার লিখার ছত্রে ছত্রে যৌবনের প্রতি আবেগ এবং উন্মত্ত ভালোবাসা বেরিয়ে আসে।
তবে সেই যৌবন পুরুষের যৌবন। আরও স্পষ্ট করে বললে, প্রভাবশালী লর্ড কুইন্সবেরির সুদর্শন ছেলে আলফ্রেড ডগলাসের প্রতি তার উন্মত্ত ভালোবাসা।
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, অস্কার ওয়াইল্ডের রূপসী স্ত্রী ছিল, তাদে দু’টো পুত্রসন্তানও ছিল, এবং দাম্পত্য জীবনে কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু একজন সত্যিকারের সাহিত্যিকের মনে শিল্পীস্বত্বা আর ব্যক্তিস্বত্বা দু’টো আলাদা জিনিস, সমান্তরালে চলে। আর তাই শিল্পী অস্কার ওয়াইল্ডের কলমে ফুটে উঠেছিল যৌবনের ভালোবাসা, পুরুষের যৌবন। কিভাবে আদালতে নাটকের পর নাটক অনুষ্ঠিত হতে থাকলো, বিশেষ করে তার অমর সৃষ্টি ‘দ্য পিকচার অফ ডোরিয়ান গ্রে’ এবং শিল্প-সাহিত্যে শ্লীল-অশ্লীলতার মাত্রা নিয়ে আদালতে আইনজীবিদের বাকবিতন্ডা এবং তার বুদ্ধিদীপ্ত জবাব, সুনীল সেগুলো উঠিয়ে এনেছেন জীবন্তভাবে। বিচারে তার শাস্তি হলো দুই বছরের কারাদন্ড।
কারাভোগের পর বেরিয়েই সম্ভবত তিনি তার সবচেয়ে কঠিন শাস্তিভোগ শুরু করলেন – উপেক্ষা, লাঞ্ছনা আর ঘৃণা। আকাশ্চুম্বী জনপ্রিয়তার একজন সাহিত্যিকের জন্য যেটা হয়তো মৃত্যুযন্ত্রণার চেয়েও কঠিন।
এইভাবে একে একে এগারো জন মানুষের জীবনে বিচারের নামে প্রহসনের ছবি একেছেন সুনীল, প্রতিটা বিচারই ছিল আইন বা নিয়মের চেয়ে তৎকালীন সমাজের সংস্কার এবং রাজনীতির আগ্রাসনের বহিঃপ্রকাশ। এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেল্বার মত বইটি আমাদেরকে আদালত এবং এর চারপাশে ঘিরে থাকা মানুষজনের মানসিক দ্বন্দ্বমুখর চিন্তা এবং স্রোতের বিপরীতে অটল হয়ে দাঁড়ানো লৌহকঠিন দার্শনিক, বিল্পবী কিংবা কোমলমনা শিল্পী-সাহিত্যিকদের সাহসের বিপরীতমুখী অবস্থানকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
শেষ করবার আগে সুনীলেরই একটি বক্তব্য টানতে চাই, যেটা তিনি ব্যবহার করেছিলেন বইয়ের ভূমিকায়।
‘আমাদের দেশের ইতিহাসে এ জাতীয় কুখ্যাত কোন বিচারের কাহিনী নেই। পরাধীনতার কাল ব্যতীত অপরের যে কোন মতামত ব্যক্ত করতে দেওয়ার মত উদারতার অভাব এখনও এ দেশের মানুষের হয়নি।’
উদারতার অভাব হয়নি এ অঞ্চলের মানুষদের ?
উপমহাদেশ জুড়ে চলমান অসহিষ্ণুতা, ঘৃণার চাষাবাদ আর আইন-আদালত-অধিকার নিয়ে নোংরা রাজনীতির কুৎসিত ছবি দেখলে এই বইয়ের পান্ডুলিপি হয়তো পুড়িয়ে ফেলতে চাইতেন তিনি।
নীললোহিতের সৌভাগ্য, এগুলো এখন আর তাকে দেখতে হচ্ছে না।
But strange that I was not told
That the brain can hold
In a tiny ivory cell
God’s heaven and hell!
(Roses and Rue, Oscar Wilde)
————————-
যারা মনস্থির করেছেন ১৯৩ পৃষ্ঠার বইটা পড়ে ফেলবেন, ১৪ মেগাবাইটের বইটা নামিয়ে নিন এখান থেকেঃ বরণীয় মানুষ, স্মরণীয় বিচার