সৃষ্টির আদিকাল থেকেই আমাদের সমাজ জীবনের সবচেয়ে অনাকাঙ্কাখিত অথচ অবিচ্ছেদ্য একটি অনুষঙ্গ হল যুদ্ধ। এ পর্যন্ত জীবন ও সম্পদের কত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার হিসেব টানা অসম্ভব হলেও সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে বেড়েছে মানুষের মানবিকতা, আর তাই যুদ্ধকালীন সময়ের জন্য বিশেষভাবে কিছু খণ্ড আইন বিশ্বজুড়ে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। ওল্ড টেস্টামেন্টে আমরা এ ধরণের কিছু বিধান পাই, সম্রাট অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধের পর ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে কিছু আইন করেন, ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা:) এবং প্রথম খলীফা আবু বকর (রা:) যুদ্ধবন্দী এবং যুদ্ধের সময়কার আচরণ সম্পর্কিত বেশ কিছু সুস্পষ্ট মূলনীতি তৈরী করেন। প্রাচীণ কাল, মধ্যযুগ এবং বিশ্বযুদ্ধের যুগ পেরিয়ে থার্মো-নিউক্লিয়ার অস্ত্রের যুগে প্রবেশ করেছি আমরা, আর তাই গ্লোবাল ভিলেজের জন্য প্রণীত হয়েছে একটি নির্দিষ্ট আইন, যুদ্ধ-সংঘর্ষ বা যে কোন ক্রান্তিকালীন সময়ে মানবাধিকার সমুন্নত রাখবার যথাসাধ্য সুযোগটি তৈরি করে দেয়াই এর মূল লক্ষ্য। মূলত উনিশ শতকের পর থেকেই আন্তর্জাতিক মানবিক আইন বা IHL – আইএইচএল বিস্তৃতি লাভ করতে শুরু করে; দু’দুটি বিশ্বযুদ্ধ এবং এর পরবর্তী স্নায়ুযুদ্ধ, বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং গৃহযুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সংযোজন-সংশোধন প্রক্রিয়া পার হয়ে এখন এটি একটি পর্যায়ে চলে এসেছে। আজকে তাই যে কোন যুদ্ধ-সংগ্রামে জড়িত পক্ষগুলোকে ক্ষয়ক্ষতি, মানবাধিকার এবং আরও অনেকগুলো বিষয় মাথায় রেখে কাজ করতে হয়, যদিও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে দেখা যায় – আইএইচএল বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ’শক্তের ভক্ত, নরমের যম’। অর্থাৎ, বিশ্বের নেতৃস্থানীয় রাষ্ট্রগুলোর কোন বিষয় নিয়ে শক্ত কোন অবস্থান এখনও পর্যন্ত দেখা যায়নি।
আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের সম্ভবত সহজতম সংজ্ঞাটি রেডক্রস দিয়েছে, যেখানে বলা হচ্ছে – এটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক আইনের সেই শাখা যা কোন সংঘর্ষ বা যুদ্ধে সহিংসতার (Violence) মাত্রা কমিয়ে এনে নিরীহ বেসামরিক মানুষদের জীবন-সম্পদ রক্ষা করে, এবং যুদ্ধের উদ্দেশ্য পূরণ করতে ন্যূনতম যতটুকু প্রয়োজন, শুধুমাত্র ততটুকু সহিংসতাকেই বৈধতা দেয়। এ ক্ষেত্রে আইনের দু’টি প্রতিষ্ঠিত নীতি – Jus Ad Ballum অর্থাৎ ‘যুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের বৈধতা’ এবং Jus In Bello বা ‘যুদ্ধকালীন সময়ে মানবাধিকার রক্ষা’ – এর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। অর্থাৎ ‘যুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের বৈধতা যেন যুদ্ধকালীন সময়ে মানবাধিকার রক্ষায় কোন বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায়। যদিও এই সংজ্ঞায় আইনটির বেশ কিছু সীমাবদ্ধতাও কিন্তু চোখে পড়বার মত, যেমন – সহিংসতা বন্ধ করবার কোন কথা এখানে নেই, যুদ্ধের উদ্দেশ্য বৈধ বা যুক্তিযুক্ত কি না তা যাচাই না করেই ধরে নেয়া হচ্ছে, উদ্দেশ্যটি বৈধ। এছাড়াও এ আইনটি যুদ্ধকালীন সময়ে সকল ক্ষতিগ্রস্থকে সাহায্য করতে পারে না। তবে সীমাবদ্ধতা থাকবার পরও আইএইচএল ক্রান্তিকালীন সময়ে মানবাধিকার রক্ষায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কার্যকর, আর বিভিন্ন নতুন সংযোজন এর উপযোগিতা আরও বাড়িয়ে চলেছে। তবে সমালোচকরা এটিকে সবসময় বলেন ‘বাস্তবতা থেকে একটি যুদ্ধ পিছিয়ে (One war behind Reality) থাকা আইন’, অর্থাৎ প্রতিটি যুদ্ধ নিত্য-নতুন সমস্যা নিয়ে আসে, যার নতুন সমাধান খুজতে হয় এই মানবিক আইনে।
স্যার হেনরী ডুনান্ট – রেডক্রসের প্রতিষ্ঠাতা
আইএইচএল এর যাত্রা শুরু হয় মূলত ১৮৫৯ সালে ইতালির উত্তরাঞ্চলে সংঘটিত ত্রিপক্ষীয় সলফেরিনো যুদ্ধের পর থেকে। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইতালির মধ্যকার এ যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন সুইস মানবাধিকার কর্মী ও রেডক্রস প্রতিষ্ঠাতা হেনরি ডুনান্ট (সে সময়ে তিনি ছিলেন ব্যবসায়ী)। ফিরে এসে একটি স্মৃতিচারণমূলক বই লিখেন তিনি, এবং তার আবেদন আলোড়ন তোলে ইউরোপজুড়ে। ছোট আকারে একটি কমিটি গঠিত হয় (এটিই ছিল রেডক্রসের পূর্বপুরুষ!) এবং তারা সুইস সরকারের কাছে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের অব্যাহত দাবী জানাতে থাকেন। ১৮৬৪ সালে জেনেভাতে অনুষ্ঠিত হয় এ সম্মেলন এবং তাতে যুদ্ধকালীন সময়ে আহত ব্যক্তিদের ব্যবস্থা সম্বলিত ‘জেনেভা কনভেনশন’ গৃহীত হয়। মূলত এখান থেকে যাত্রা শুরু করেই আজ পর্যন্ত বিভিন্ন কনভেনশন এবং প্রোটোকল নিয়ে এগিয়ে চলেছে আইএইচএল।
কাল পরিক্রমায় আন্তর্জাতিক মানবিক আইন
১৮৫৯ ~ হেনরি ডুনান্ট কর্তৃক সলফোরিনো যুদ্ধে আহতদের সহায়তা প্রদান
১৮৬৩ ~ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘লিবার কোড’ প্রণয়ন/ জেনেভায় রেডক্রস কমিটি গঠন।
১৮৬৪ ~ প্রথম জেনেভা কনভেনশন
১৮৬৮ ~ সেন্ট পিটার্সবার্গ ঘোষণা – বিপদজনক কামানের গোলা ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত
১৮৮০ ~ ভূমিতে সংঘটিত যুদ্ধ সংক্রান্ত ‘অক্সফোর্ড ম্যানুয়াল’ প্রকাশ
১৯০৭ ~ হেগ কনভেনশন
১৯১৩ ~ নৌ যুদ্ধ সংক্রান্ত ‘অক্সফোর্ড ম্যানুয়াল’ প্রকাশ
১৯২৫ ~ প্রথম জেনেভা কনভেনশন – যুদ্ধবন্দী সংক্রান্ত
১৯৪৫/ ১৯৪৮ ~ জার্মানিতে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল/ জাপানে টোকিও ট্রায়াল অনুষ্ঠিত
১৯৪৯ ~ প্রথম – দ্বিতীয় – তৃতীয় ও চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন প্রণয়ন ও গ্রহণ
১৯৫৪ ~ হেগ কনভেনশন – যুদ্ধের সময় ঐতিহ্যবাহী/ সাংস্কৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংক্রান্ত
১৯৭৭ ~ জেনেভা কনভেনশন – দু’টি অতিরিক্ত প্রটোকল গ্রহণ
১৯৮০ ~ জাতিসংঘ কনভেনশন – কিছু বিশেষ ধরণের অস্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ সংক্রান্ত
১৯৯৩ ~ প্যারিস কনভেনশন – রাসায়নিক অস্ত্র তৈরী, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ সংক্রান্ত
১৯৯৩/১৯৯৪ ~ যুগোস্লাভিয়া (ICTY) এবং রুয়ান্ডাতে (ICTR) যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার অনুষ্ঠিত
১৯৯৫ ~ জাতিসংঘ কনভেনশন (১৯৮০) – লেসার অস্ত্র ব্যবহার সংক্রান্ত প্রটোকল গ্রহণ
১৯৯৬ ~ জাতিসংঘ কনভেনশন (১৯৮০) – ভূমি-মাইন ব্যবহার সংক্রান্ত প্রটোকল গ্রহণ
১৯৯৭ ~ অটোয়া কনভেনশন – ভূমি-মাইন ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ সংক্রান্ত
১৯৯৮ ~ রোম স্ট্যাটুট – আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) সৃষ্টি
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC), দ্য হেগ, নেদারল্যান্ডস
দুইটি বিশ্বযুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতা সামনে রেখে যুদ্ধ এবং যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি আইএইচএল এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল এবং জাপানের টোকিও ট্রায়ালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার সম্পন্ন হওয়াতে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বিধি প্রণয়ন জরুরী হয়ে পড়ে। তাই পূর্বেকার বিভিন্ন সম্মেলন ও চুক্তিগুলোর তত্ব গ্রহণ ও পরিমার্জন করে ১৯৪৯ সালে গৃহীত হয় চারটি জেনেভা কনভেনশন। এর মধ্যে প্রথম কনভেনশনটির আলোচ্য বিষয় যুদ্ধক্ষেত্রে আহত ব্যক্তিদের সেবা, দ্বিতীয় কনভেনশনটিও সমুদ্র বা নৌ-যুদ্ধে আহত বা অসুস্থ ব্যক্তির সেবা সংক্রান্ত। তৃতীয় কনভেনশনটি যুদ্ধবন্দীদের সাথে আচরণবিধি। চতুর্থ কনভেনশনটি শত্রপক্ষের হাতে আটক বেসামরিক লোকদের নিরাপত্তা বিষয়ক বিধান। এছাড়াও যুগের চাহিদার সাপেক্ষে ১৯৭৭ জেনেভা কনভেনশনের দু’টি অতিরিক্ত প্রোটকল গৃহীত হয়। প্রথমটি শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যুদ্ধের সময়ে কার্যকর, আর দ্বিতীয়টি শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা বা গৃহযুদ্ধের সময়ে কার্যকর। এছাড়াও জাতিসংঘ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চুক্তি কিংবা কনভেনশন গ্রহণ করেছে, সেগুলোও আইএইচএল এর জন্য কার্যকর। সর্বশেষে ১৯৯৮ সালে রোম স্ট্যাটুট এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত, যা যুদ্ধকালীন সময়ে সংঘটিত অপরাধসমূগের তদন্ত ও বিচার করে থাকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এ পর্যন্ত আইএইচএল যুদ্ধকালীন সময়ে মানবাধিকার রক্ষায় শক্ত ভূমিকা রেখেছে বলা চলে। বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধাপরাধের দায়ে আটক ও বিচাররত ব্যক্তিদের তালিকায় দোর্দন্ডপ্রতাপশালী একনায়কদের দেখে বিশ্ববাসী আশান্বিত হয় ন্যায়বিচার পাবার আশায়। চিলি’র অগাস্টো পিনোশে, তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার স্বৈরশাসক স্লোবাদান মিলোসোভিচ এমনকি সুদানের বর্তমান রাষ্ট্রপতি ওমর আল বশিরের বিরুদ্ধেও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনে বিচার করা হয় আন্তর্জাতিক আদালতে, যা আইনের শাসন নিশ্চিত করে। রাসায়নিক বা বিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ কিংবা যুদ্ধবন্দীদের মানবাধিকার রক্ষা সহ ক্রান্তিকালীন সময়ে আরও নানা ধরণের নিরাপত্তা আইএইচএল দেয়, এটি সত্য। তবে মুদ্রার অপর পিঠটি খুব একটা সুখকর নয়। জাতিসংঘ, নিরাপত্তা পরিষদকে পাশ কাটিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা এর মিত্র দেশগুলো যখন একক সিদ্ধান্তে আফগানিস্তান, ইরাক কিংবা পাকিস্তানে বিমান হামলা সহ সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে যায়, এর বিরুদ্ধে প্রশ্ন উত্থাপন করবার মত কেউ থাকে না। আবার, আন্তর্জাতিক রাজনীতিও আইএইচএল এর প্রয়োগে ভূমিকা রাখে; যেমন – কোন দেশের স্বাধীনতাকামী বা স্বৈরাচারবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামে সাধারণত পরাজিত পক্ষকেই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। শ্রীলঙ্কা সরকার যখন বিদ্রোহী তামিলদের সফলভাবে দমন করে, মাত্রাতিরিক্ত সহিংসতা থাকলেও তখন তা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গৃহীত হয় না, আবার লিবিয়া সরকার যখন বিদ্রোহীদের দমন করে, তখন তাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য করার চেষ্টা চালানো হয়। এমন কি জীবনের নিরাপত্তার আশায় লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফি পুত্র সাইফ এখন নিজে থেকেই আন্তর্জাতিক আদালতে আত্নসমর্পণ করতে চাচ্ছেন।
সব মিলিয়ে আপদকালীন পরিস্থিতিতে যখন প্রচলিত আইন কাজ করতে পারে না, যখন মৌলিক অধিকারগুলো পর্যন্ত স্থগিত হয়ে যায় তখন ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও জীবনের নিরাপত্তা একমাত্র আইএইচএল এর মাধ্যমেই দেয়া সম্ভব। তবে সত্যিকার অর্থে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসতে হবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে থাকা দেশগুলোকেই। তারা যদি নিজেদেরকে জবাবাদিহিতা এবং স্বচ্ছতার জায়গাটিতে নিয়ে আসতে পারে, তাহলে সত্যিকার অর্থে যুদ্ধ ও তার বীভৎসতা থেকে মুক্তি পাবে পৃথিবী।