‘স্ট্রাইক’, ‘বন্ধ’ প্রভৃতি নামে পৃথিবীর দেশে দেশে হরতালের ধারণা প্রচলিত। আন্দোলনের মাধ্যম হিসেবে এটি ‘সাংবিধানিক অধিকার’ও বটে। তবে, হরতাল অর্থ যদি হয় জ্বালাও-পোড়াও, ভাংচুর কিংবা জনমনে ত্রাস সৃষ্টি, সে ক্ষেত্রে হরতালের ন্যায্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য।

Hartal

হরতালের এই চিত্র কোনো নাগরিকের কাম্য নয়

হরতাল- আমাদের দেশের আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। উপমহাদেশের ইতিহাসে সেই ব্রিটিশ বিতাড়নের মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে অসহযোগ আন্দোলনের পথ ধরে মহাত্মা গান্ধীর হাতেই সৃষ্টি হয় অধিকার আদায়ের এই নতুন মাধ্যমের (‘হরতাল’ শব্দটিও গান্ধীজির পিতৃভূমি গুজরাটের ভাষা)। তবে ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের শক্ত হাতিয়ার হরতাল আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পরিণত হয়েছে সবচেয়ে বিতর্কিত একটি ইস্যুতে। সরকার ও বিরোধী দলের ইঁদুর-বিড়াল খেলা এবং হরতালের মতো পেশীশক্তির প্রদর্শনী সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে তোলে, অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির কথা না-ই বা বললাম। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে হরতালের আইনি ভিত্তি আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয়।

বাংলাদেশ সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসেবে ৩২ অনুচ্ছেদে জীবন ধারণের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ৩৬ অনুচ্ছেদে দেশের যে কোনো স্থানে অবাধে চলাফেরার অধিকার দেয়া আছে, ৪০ অনুচ্ছেদে নিজ পেশা কিংবা ব্যবসা চালাবার অধিকারটি সংরক্ষিত। বারো ঘণ্টার একটি হরতালেও উপরের সবগুলো অধিকার লঙ্ঘন হয় চরমভাবে। আবার দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে কিংবা রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির কারণে এই হরতালের পক্ষে অবস্থান নেয়া লোকের সংখ্যাও কম নয়। গাড়িতে আগুন দেয়া কিংবা ককটেল ফোটাতে গিয়ে প্রাণ হারানো লোকদের জন্য আইন কী সহায়তা দিতে পারবে সেটা বিবেচনা করা যেমন দরকার, তেমনিভাবে যে সব অনিবার্য কারণে হরতাল দেয়া হচ্ছে, সেগুলো কিভাবে অন্য কোনো কার্যকর মাধ্যমে সমাধান করা যায় সেটিও মাথায় রাখতে হবে। আবার হরতালের নামে দেশে যেন অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়, সেটিও বিবেচ্য বিষয়। ১৯৯৬ সালে সংসদ নির্বাচনের পর বিরোধী দল বিএনপির ডাকা লাগাতার হরতালের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন খন্দকার মোদাররেস এলাহী। ২০০০ সালে দেয়া মামলাটির রায়ে হাইকোর্ট ডিভিশন সহিংসতা বর্জনের আদেশ দিয়ে হরতালকে একটি গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করেন (২১ বিএলডি এইচসিডি ৩৫২)। কিন্তু সহিংসতা আর জানমালের ক্ষতি যখন ক্রমশ বেড়েই চলেছে, তখন তা রোধ করার জন্য হরতাল নিষিদ্ধ করবার উদ্যোগ নেয় বিচার বিভাগ। ১৯৯৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট ডিভিশনের একটি বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন- ‘কেন হরতালকে বেআইনি এবং এর সহিংসতাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে না।’ শুনানি শেষে ১৯৯৯ এর ১৫ মে হরতালকে সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করেন আদালত। তবে হরতালের পক্ষে-বিপক্ষে জোরজবরদস্তি কিংবা সহিংসতা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এবং এর প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে নির্দেশ দেয়া হয়। বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। দীর্ঘ আট বছর পর ২০০৭-এর ২ ডিসেম্বর আপিল বিভাগ রায় দেন, যার মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। প্রথমত, এটি পূর্বেকার রায়- ‘হরতাল সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক অধিকার’ বহাল রাখে। দ্বিতীয়ত, হাইকোর্ট বিভাগের সিদ্ধান্ত_ ‘জোরজবরদস্তি কিংবা সহিংসতা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ’ বিষয়টিকে উল্টে দিয়ে বলা হয়, সহিংসতা বা জবরদস্তিমূলক কর্মকা-ের জন্য দ-বিধি কিংবা ফৌজদারি কার্যবিধি যথেষ্ট, আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন নেই (৬০ ডিএলআর এডি ৪৯)। অবশ্য এই রায়ের কদিন আগে, ২০০৭-এর ১১ জুন আওয়ামী লীগসহ সমমনা দলগুলো ‘ঢাকা অবরোধ’ কর্মসূচি দেয়। একটি জনস্বার্থ মামলার ভিত্তিতে ১০ জুন রুল জারি করে ওই সমাবেশ আয়োজনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে আদালত। গণতান্ত্রিক বা রাজনৈতিক কার্যক্রমে আদালতের এ ধরনের হস্তক্ষেপ তখন ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়, সম্ভবত এই কারণে পরবর্তীকালে রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষেত্রে উচ্চ আদালত থেকে সরাসরি কোনো সিদ্ধান্ত সাধারণত দেয়া হয় না।

প্রতিবেশী দেশ ভারতের আদালতে ১৯৯৭ সালে ‘ভারত কুমার বনাম কেরালা রাজ্য’ মামলায় সুপ্রিমকোর্ট জনস্বার্থের দিক বিবেচনা করে ঝুঁকিপূর্ণ বা ক্ষতিকর কোনো উপায়ে বা কারণে ‘বন্ধ’ (ভারতে হরতাল এ নামেই পরিচিত) ডাকা বেআইনি ঘোষণা করেন। সাধারণ মানুষ এ রায়কে ব্যাপকভাবে স্বাগত জানালেও রাজনীতিবিদগণ তো বটেই, এমনকি আইনজীবীরাও আদালতের ‘অতি সক্রিয়’ ভূমিকার সমালোচনা করেন। একইভাবে ‘রঙ্গরাজন বনাম তামিলনাড়ু রাজ্য’ মামলায় সরকারি কর্মচারীদের ‘স্ট্রাইক’ বা কর্মবিরতিকে জনস্বার্থহানিকর বলে বেআইনি ঘোষণা দেয়া হয় এবং এ রায়টিও যথেষ্ট বিতর্কিত হয়। মোদাররেস এলাহী মামলার রায় অনুযায়ী, শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল ডাকা এবং পালন করা সাংবিধানিক অধিকার (অনুচ্ছেদ ৩৯ – মত প্রকাশের স্বাধীনতা) হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু যখনই এর সাথে ভয়ভীতি বা জোরজবরদস্তি, সহিংসতা চলে আসবে, তখন তা আর আইনসিদ্ধ থাকবে না। একই বিষয় প্রতিফলিত হয়েছে ‘মান্নান ভূঁইয়া বনাম বাংলাদেশ’ মামলার রায়টিতেও। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ হরতাল এলেই এখনো জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন আর সংঘর্ষের অভিনয় বারংবার দেখতে থাকে। বাংলাদেশ দন্ডবিধির অষ্টম অধ্যায়ে গণশান্তির পরিপন্থী অপরাধসমূহের জন্য শাস্তির বিধানগুলো সুস্পষ্টভাবে বলা আছে। বেআইনি সমাবেশে যোগদান করে গণশান্তির পরিপন্থী কাজ করলে ৬ মাসের জেল কিংবা জরিমানা হতে পারে। আবার, মারাত্মক অস্ত্রসজ্জিত হয়ে বেআইনি সমাবেশে যোগদান করলে শাস্তির মেয়াদ হতে পারে দুই বছর কারাদন্ড। এছাড়াও বর্তমানে সরকার মোবাইল কোর্ট ব্যবহারের মাধ্যমে হরতালে বিশৃঙ্খলাকারীদের তাৎক্ষণিক বিচার প্রক্রিয়া চালু করেছে, যাতে ৬ মাস পর্যন্ত কারাদ- দেয়া যেতে পারে। তবে দুঃখজনক বিষয় হলো, এই আইনগুলোর সফল প্রয়োগ আমরা সাধারণত দেখতে পাই না, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক হয়রানিমূলক কাজেই অস্ত্র হিসেবে আইনগুলো ব্যবহার করা হয়। হরতাল দমন করতে গিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যকলাপে জন্ম নেয় হরতালের চেয়ে আরো বড় কিছু, বাড়তে থাকে দুর্ভোগ।

গণতান্ত্রিক পরিবেশে হরতাল একটি স্বীকৃত অধিকার, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু হরতালের অর্থ যদি হয় গাড়ি ভাংচুর আর লাশের মিছিল, তাহলে আইনও সেখানে অসহায় হয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ প্রণয়ন করেন দেশের আইন, আবার তারাই দলীয় স্বার্থরক্ষার জন্য হরতালের পক্ষে-বিপক্ষে সহিংস অবস্থান নিয়ে বিপন্ন করে তোলেন সেই মানুষের জানমালের নিরাপত্তা। আদালত তাই রাজনৈতিক বিষয়গুলোকে রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছার ওপর ছেড়ে দেয়ারই পক্ষপাতি। সাদা চোখে দেখলে হরতাল কোনো সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় না, যদি না একে জোর করে হিংস্রভাবে সবার জন্য বাধ্যতামূলক করে দেয়া হয়। আইন তাই এখানে জনগণের শুভবুদ্ধি এবং তাদের সমর্থনপুষ্ট রাজনীতিবিদদের মনুষ্যত্ব এবং দেশপ্রেমের ওপরই গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনের কিস্তিমাতের সুযোগটি রেখে দিয়েছে